দেশ বিদেশ, পথে-ঘাটে, লেখনী, প্রবাসীর চিঠি

Thursday 17 December 2009

পথে-ঘাটে ৬ ... স্কুটার

পথে-ঘাটে


স্কুটার

সে দিন শনিবার্। আলসেমিটা কোনও মতে কাটিয়ে সকালের চা, মুড়ি আর মুখরোচক চানাচুর দিয়ে প্রাতরাশ।

দিবাকর আর চিত্ত ঘুরছিল সাউদার্ন এভিনিউ-এ। চিত্ত এক প্রতিষ্ঠানের ট্রান্সপোর্ট ইঞ্জিনিয়ার ... দিবাকরের সাথে পরিচয় সেই ম্যাক্স-মূলার ভবনের জার্মান-ভাষা ক্লাস থেকে ... সেদিনের পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। কখনও সপ্তাহান্তে অথবা কোনও ছুটির দিনে সময় পেলে ও দিবাকরকে স্কুটার চালানো শেখায়। সেদিন টালিগঞ্জ লেকের পাশ দিয়ে স্কুটার চালাচ্ছিল দিবাকর। এই রাস্তায় এমনিতেই খুব একটা ভীড় থাকে না, আর এ সময়টায় প্রায় ফাঁকাই বলা চলে। ড্রাইভিং প্র্যাক্টিস করবার পক্ষে উপযুক্ত রাস্তা বটে।

আরে... দীপদা না! ... স্কুটার নিয়ে হুস করে বেরিয়ে গেল। তাইতো দীপদা-ই হবে, জয়া কলেজের এক বান্ধবীর সাথে শনিবার দুপুরের নিরিবিলি সাউদার্ন এভনিউ-এ যেতে যেতে হটাত নজরে পরল দিবাকর-কে। জয়ার ডাক ওর কানে আর পৌঁছোয় নি। ভালই হয়েছে, ওঃ 'দীপদা কিং অব দ্য রোড্'... ছোট্ট মেয়ের মত নেচে উঠল জয়ার মন দুষ্টুমিতে। আসুক না আজ দীপদা... বেশ ভাল করে রাগানো যাবে।

বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই জয়া হট্টগোল শুরু করে দিল...
- মা, মা শুনছ ... কোথায় গেলে তুমি!...
চেঁচামেচির ঠেলায় নাসিম মাসী আর আমীর দুজনেই কাজ-কর্ম সব স্থগিত রেখে এসে পড়ল...
- আরে, ব্যাপারটা কি? এত সব চেঁচামেচি... তা হ'লটা কী?
- দীপদাকে দেখলাম আজ - রাস্তায়, ডাকলাম কিন্তু একবার তাকিয়েও দেখল না।
- দূর, কাকে না কাকে দেখেছিস ... অমনি দীপদা হয়ে গেল! দিবাকর তোকে চিনবে না, এটা হ'তেই পারে না। ... বলল আমীর।

নাসিম মাসী একটু হেসে ভর্তসনা স্বরে বললেন
- পাগল মেয়ে, দীপ ও রকম ছেলে হতেই পারে না... রাস্তায় কাকে দেখেছিস! নতুন চশমার দরকার বোধ হয়!
- হ্যাঁ, আমার চোখ খারাপ, মাথাটাও হয়ত খারাপ... আরে, আমি স্বচক্ষে দেখলাম দীপদা সাদার্ন এভনিউ-এ স্কুটার চালিয়ে যাচ্ছে। পিছনের সীট-এও ছিল একজন, দীপদার কোনও বন্ধু-টন্ধু হবে। দেখতে পেয়ে ডাকলাম, কিন্তু ফিরেও দেখল না।
- ওঃ, জয়া... বড় বুদ্ধিমতী বোন আমার। তোর ডাক তো দীপ শুনতেই পায় নি! তা, ফিরে আর দেখবে কাকে?
- হ্যাঁ, ঠিক তাই হবে ... আর সে যাই-ই হ'ক, দীপদাকে একটু রাগাতে হবে।
নাসিম মাসী ধূপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন ...
- জয়া, ঠিক দেখেছিস কি দীপকে স্কুটার চালাতে? ...
- আরে হ্যাঁ মা, হ্যাঁ, দীপদাকে চিনতে আমার ভুল হবে নাকি ... তোমাদের হয়েছে-টা কী?
- না, কিচ্ছু না।

মা-র কণ্ঠস্বর হটাত কেন যেন অপরিচিত, বিচলিত লাগল জয়া আর আমীর এর কাছে। একটু থমকে থেকে জয়া এগুলো রান্না ঘরের দিকে।

***

ড্রাইভিং প্র্যাক্টিস তারপর 'মৌচাক'-এ মিষ্টি খাওয়া আর কিছুটা সময় আড্ডা। কেটে গেল গোটা দুপুর - টের পাওয়ার আগেই। যাদবপুর বাড়ির পথেই পরে, চিত্ত দিবাকরকে বাস-স্ট্যান্ড অবধি পৌঁছে দিল।

দরজাটা জয়াই খুলল।
- এস দীপদা, বস এক সেকেন্ড - চা আনছি।

দীপের বহু দিনের চেনা ঘর, নিজেদের বাড়ির মতই। কোনও ফর্মালিটির বালাই নেই ... সহজ, আন্তরিক। শনিবার অপরাহ্ণ, রোদটাও কমেছে আর সেই সাথে গরমটাও। ছেলে মেয়েরা বেরুচ্ছে ধীরে ধীরে। খোলা জানালায় ভেসে আসছে মৃদু কোলাহল, আর তারই সাথে এদিক ওদিক থেকে পড়শীদের রেডিওর নানা গানের মিশ্রণ। আমীর নিমগ্ন ছিল একটা বই নিয়ে। বইটা নামিয়ে রেখে বসল দিবাকরের পাশে।

- তারপর, কেমন আছ দীপ?
- আরে, বেশ ভাল। আজ একটু ড্রাইভিং প্র্যাক্টিস করলাম, মোটামুটি ভালই হচ্ছে। মাসীমা কোথায়?
- মা রান্না ঘরে, সম্ভবতঃ পেঁয়াজী টেয়াজী কিছু করছে জয়ার সাথে।

গরম চা আর তার সাথে নাসিম মাসীর তাজা পেঁয়াজী নিয়ে জয়া আর মাসী দুজনেই হাজির। কাপগুলোতে চা ঢেলে সবাইকে দিতে দিতে জয়া বলল...
- আচ্ছা, দীপদা তোমাকে আজ দেখেছি বলে মনে হচ্ছে। তুমি কি আজ দুপুরে স্কুটার চালাচ্ছিলে ... সাদার্ন এভিনিউ-এ?
- হ্যাঁ, তাই তো, কিন্তু তুমি কোথায় ছিলে?
- আরে, আমি কলেজের এক বান্ধবীর সাথে ওই রাস্তায় ঘুরেছিলাম... তোমাকে ডাকলাম, কিন্তু তুমি দেখলেই না।
- আচ্ছা পাগল তো তুমি... শুনতে না পেলে, সাড়া দিই কী ভাবে, আর দেখবই বা কী করে? দেখছেন মাসীমা কেমন সব পাগলের মত কথা বলছে!
... হাসতে হাসতে বলল দিবাকর।

নাসিম মাসী কোনোও সাড়াশব্দ নেই, কথার উত্তর দেওয়ার কোনও প্রচেষ্টা না করে, অকারণ চা-কাপটা নাড়াচাড়া করছেন, কেমন যেন উদাস, অনুপস্থিত। কোনও কারণে এক বিষাদ ভরা ছায়া আবৃত করছে তাঁর মুখমণ্ডল ... এটা কারও নজর এড়ালো না। একটু অস্বস্তিকর পরিস্থিতি- অনুভব করল সবাই। ব্যাপারটা কী বুঝতে না পেরে চুপ রইল দিবাকর। জয়া আর আমীর - দুজন প্রায় এক সাথে জিজ্ঞাসা করল,
- কী হয়েছে, মা?
- আরে না, কিছু না তো!
- না, তা হবে না ... এভাবে কথাটা এড়ানো চলবে না। বল না মা, কী ব্যাপার, আজ দুপুর থেকেই তুমি কোন্‌ও কারণে মুষড়ে আছ। তুমি না বললে আমাদেরও শান্তি নেই।

একটু নীরব থেকে নাসিম মাসী ম্লান হেসে বললেন...
- আজ দুপুর থেকেই মনটা খারাপ হয়ে উঠেছে। জয়া যখন হৈচৈ করে খবর দিল দীপের স্কুটার চালানোর কথা, তখন থেকে তোলপাড় হচ্ছে হৃদয়।
মাসীর কথা শুনে দিবাকর ত' হত-বাক, ব্যাপারটা ওর বোধগম্য হ'ল না মোটেই। শুধু দিবাকর নয় সবাই অপ্রস্তুত। ক্ষণিকের সে নিস্তব্ধতা, জড়তা কাটিয়ে মৃদুস্বরে দিবাকর চাইল মাসীর দিকে, বলল-
- হ্যাঁ মাসীমা, আজ স্কুটার ড্রাইভিং প্র্যাক্টিস করছিলাম,- তা ওতে দোষটা কী হ'য়েছে! ...
- না, না দীপ... তোমার দোষ কোথায়! তুমি ড্রাইভিং শিখছ এক তিল-ও দোষ নেই এতে। তবে তোমার স্কুটার চালানোর কথা শুনতেই খচ্‌ করে উঠল মনটা।
কোন কিছু বুঝতে না পেরে, ফ্যাল্-ফ্যাল্‌ করে চাইল সবাই নাসিম মাসীর দিকে।
- এই স্কুটারের বলিদান হয়েছে আমার সব চাইতে প্রিয় মানুষের ... আমার সকল প্রাণের ভালবাসা সুব্রত-কে ছিনিয়ে নিয়েছে ঐ স্কুটার। তাই স্কুটার কথাটা শুনলে উথাল-পাথাল হয়ে ওঠে আমার মন। দীপ, এই কটা দিন হ'ল মাত্র, কোথা থেকে তুমি এলে এখানে, ঠাঁই করে নিলে আমাদের মাঝে ... এখন, এ পরিবারে আমাদের-ই একজন। এ কারণে মনটা কোনও এক আশঙ্কায় খারাপ হয়ে গেল।

মাসীর কথা গুলি স্পর্শ করল সবাইকে। আমীর বলল ...
- বাবার এ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল সেটা আমরা জানি, কিন্তু সব কিছু বিস্তৃত ভাবে জানা নেই আমাদের। আর নূতন ক'রে তোমার আঘাত লাগবে এই ভয়ে, এ প্রসঙ্গে তোমাকে জিজ্ঞাসা করি নি আমরা - কোনও দিন।
- শুধু ওই স্কুটার এ্যাকসিডেন্ট নয় ... আরও অনেক কথা, আমাদের কথা, সুব্রত আর আমার কথা, যা অনেকদিন, অনেক বার বলি বলি করেও আর বলা হয় নি।
নাসিম মাসীর বিচলিত কণ্ঠ -

- যা কিছু এতদিন ধরে বয়ে বেড়াচ্ছি, আজ তাহলে বলছি তোমাদের ...

***
ক্রমশ

পথে-ঘাটে ৫ ... মর্ণিং-শো

পথে-ঘাটে



মর্ণিং-শো
টেবিলে চা এর সরঞ্জাম করা ছিল ... দিবাকর আসতেই গরম চা আর সেই সাথে হালুয়া। হালুয়াটা নাসিম মাসীর করা ... ওটা করার একটা স্পেশাল ফর্মূলা আছে নাসিম মাসীর। একটা চামচ মুখে দিয়েই দিবাকর বলল
- নাঃ, এটা খাবার নয়...
নাসিম মাসীসহ সবাই একদম থতমত... জয়া তো ঘাব্‌ড়েই গিয়েছে, বিলকুল ...
- না, মাসীমা এটা খাবার নয়... এটা হচ্ছে অমৃত।
সত্যি-ই দিবাকর জাদু জানে... মুহূর্তে আবহাওয়াটা পাল্টে গেল...
- ওঃ দীপদা, সাত জন্মেও তোমার কোনও শত্রু হবে না।
হাসিতে ভরে গেল ঘর।
- মাসীমা, আমি রবিবার সিনেমার কতগুলি পাস পেয়েছি... যাবেন আমাদের সাথে? পুরোনো বাংলা ছবি...
- দূর পাগল, খেয়ে-দেয়ে আর কিছু কাজ নেই ... সিনেমা যাও।
স্বভাবতঃ-ই সবাই কিছুটা নিরাশ... কিন্তু দিবাকর হাল ছাড়বে না। পুরোনো ভাল ছবি কিন্তু ...
- কী সে ছবি?
- শিল্পী।
- শিল্পী! হ্যাঁ, ছবিটা ভাল ঠিকই ... পাস পেয়েছ, কটা! চারজনের?
- তা, সেটা নষ্ট করে আর লাভ কি! ঠিক আছে... কিন্তু তারপর রান্না-বান্না কিন্তু তোমরা করবে। রাজী তো!
- খুউব রাজী মাসীমা...
- ওরে বাবা! দীপদা ... তুমি করবে রান্না! মানে রবিবার আমাদের গণ-উপবাস।
- দেখা যাবে!
- কেন যে দীপের পিছু লাগিস!
- ঠিক বলেছেন মাসীমা...
- মা, তুমি বড় পক্ষপাতী ... সব সময়-ই দীপের পক্ষে...
চেঁচিয়ে উঠল দুজনে।

***

রবিবারের বাজার। শহরের ঘুম ভাঙ্গেনি এখনও ... এই আধ জাগ্রত, আধ নিদ্রামগ্ন। বাস-ট্রামগুলো সব প্রায় খালিই বলা যায়। দোকান-পাট খোলে নি সব এখনও। দুই এক জন লোক বাজারের থলি হাতে মন্থর গতিতে এদিক ওদিক হাঁটছে... লেক মার্কেট অথবা যগু বাজারের দিকে, আজ আর সে দ্রুততা নেই। সাতসকালে বাস-ট্রাম আর গাড়ির কানের-পর্দা ফাটানো গর্জন প্রায় নেই, নেই মহানগরীর পথিকের চঞ্চলতা। তাই, শহরের রাস্তা যাদের বেড-রুম, রবিবার-এর কল্যাণে তারাও একটু বেশী ঘুমোবার বিলাসিতার সুযোগ থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বঞ্চিত হয় নি। একটু জাগো জাগো ভাব... কোথাও ট্যাঁ - ট্যাঁ করছে রাস্তার ধুলি মাখা কটা বাচ্চা, কোথাও বা কোন বাচ্চা আপ্রাণ চেষ্টা করছে তার ক্ষুধা বিবৃত করতে - নিরুপায় মায়ের শুষ্ক স্তনে। এদিক ওদিক আঁচ দেওয়া হচ্ছে কয়লার উনানে। কোথাও রাস্তার ধারে জলের ট্যাপ বা টিউব-কলের পাশে নিম-ডালের দাঁতন হাতে কেউ দাঁত ঘষছে। কেউবা এই সময়, ভীড় বারবার আগে ভাগেই ক' ঘটি জল ঢেলে নিয়েছে মাথায়। তাইতো ... ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে আসছে নগরীতে।

কি মুশকিল, এই সময় এক কাপ চা-ও মেলা ভার। বনফুল রেস্টুরেন্টটা পর্যন্ত খোলে নি এখনও। চেয়ারগুলি সব টেবিলের ওপর।
যাক, পাসগুলো সব চেঞ্জ করা হয়েছে ... শো সাড়ে দশটায়। সিনেমা হলের সামনে এতটা ভীড়ও নেই। এ ছবি অনেকে বহু বার দেখেছে। তবুও কিছু লোক আবার এসেছে দেখতে। হয়তবা কোন্‌ স্মৃতি জড়িত রয়েছে এর সাথে।
কটা মিনিট বাকী আছে সিনেমা হলের প্রথম অ্যালার্মটা পরতে - এখন ওরা এলেই হয়। অবশ্য এত তাড়াতাড়ির কিছু নেই... প্রথমে ত' ট্রেলার চলবে ওগুলো মিস্ করলে ক্ষতি নেই। তবুও, অন্ধকার হলে লোকের পা মাড়িয়ে সিট খোঁজা বড় যাচ্ছেতাই ব্যাপার! ...ভাবতে ভাবতেই যাদবপুরের বাসটা এসে পড়ল।
- এই দীপদা! আমরা হাজির - জনাব!
- তাইতো, দেখছি সুখের ঘুমটা ভেঙ্গেছে সময় মত!
- আর বল কেন! ভাল করে ঘুমোতেই দিল না। ভোর না হতেই- চেঁচামেচি, ধাক্কা-ধাক্কি একেবারে হুলস্থুল কাণ্ড।ভাল করে একটা চা পর্যন্ত খাওয়া হয় নি। মা-টা একেবারে ...
নাসিম মাসী হেসে বললেন-
- যত দোষ নন্দ ঘোষ - তাই না! সকাল সকাল না ওঠালে ত' আজ আর আসা হ'ত না, মর্ণিং-শো তো দূরের কথা, ম্যাটিনী-ও হ'ত কিনা সন্দেহ ... সাজ-গোঁজ করতেই ত তোর দশ ঘণ্টা সময় লাগে। আর চা পাস নি আজ!
- আরে চা খাই নি তা কে বলেছে! ভাল করে আমেজ করে খাওয়া হয় নি ... আর, বাইরে বেরুতে গেলে একটা ভাল কিছু তো পরতে হবে। রোজ রোজ তো আর সিনেমা দেখতে যাচ্ছি না!
- বেশ, বেশ এবার চল তো সবাই ভিতর য়াই। চা আমার-ও ঠিকমতো খাওয়া হয় নি। ...আর আমীর ব্যাপার কি! তুমি বোবা হয়ে গেলে নাকি! একদম স্পীক-টি নট।
- বলবার সুযোগ থাকলে ত' বলবো। জয়া আর মা শুরু করলে - আমি নো হয়্যার। চল হলে যাওয়া যাক।

কিছু কিছু ফিল্ম আছে, যে গুলো দেখবার পরে আর মেয়েদের চোখের দিকে তাকানো চলে না। এই ছবিটাও সেই জাতীয়, নাসিম মাসীর ছল-ছল চোখ দেখে সঙ্কোচ হল দিবাকরের। পরিস্থিতি একটু সহজ করতে হবে...
- ওঃ, গলাটা শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে আছে। চলুন মাসীমা কোথাও বসে এক কাপ চা-কফি খেয়ে নেওয়া যাক। আমরা সবাই গড়িয়াহাট নেমে পরলে কেমন হয়? পথেই পরছে!
- হ্যাঁ, সেটাই ভাল। কফি তাহলে আমরা ঐ সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট-এ খাব ... কি মা?

আমীরের প্রস্তাবটা খারাপ ছিল না। গড়িয়াহাটএর সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টটা বেশ ছিম ছাম, চলছে বেশ। সন্ধ্যা বেলায় একটা খালি টেবিল মেলা ত' প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার। আমীরের মতে - সবাই যখন এক সাথে রেস্টুরেন্টে কফি খাচ্ছে, তাহলে এর সাথে একটা ঢোসা মন্দ হয় না। তাই-ই হল- ঠিক। দুপুরের রান্নাটা স্থগিত রইল।

- যাও দীপদা, এবারের মত তোমার রেহাই হল।
- মানে?
- মানে, আজ আর তোমাকে রান্নাঘরে কেরামতি দেখাতে হবে না। আমরাও বাঁচলাম আজ আর উপোস দিতে হবে না - সবাইকে। তবে তোমায় ছাড়ছি না আমরা - তোমার রান্নার খেল না দেখে ছাড়ছি না - কিছুতেই।
- বড় জ্বালাতন করিস তোরা দীপকে...
- আঃ মাসীমা, পাগলের কথা ছেড়ে দিন ... কিন্তু আপনার কি হল! মন মেজাজ ভাল নেই নাকি!
- না রে, তা নয়। ভালই লাগছে সবই ... তবুও এখানে, সব কিছুর সাথে জড়িয়ে রয়েছে অনেক স্মৃতি ... মনে হয় এই সে দিনের কথা। সিনেমা দেখা, কফি হাউস, মার্কেটের সামনে অথবা গোলপার্কের কাছে রাস্তায় ফুলওয়ালার রজনীগন্ধা আর জুঁই-এর মালা, অকারণে ছাতা থাকতেও বৃষ্টিতে ভেজা। কতবার যে এই রাস্তায় সুব্রতর সাথে হেঁটেছি ... কখনও ঐ পানের দোকানে কোল্ড ড্রিংস্ কখনও রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়া... এই সব স্মৃতি ভেসে আসে। আমরাও ছিলাম এক কালে আড্ডাবাজ। এ সব কথা মনটাকে একটু উদাস করে দেয়।
জয়া একটু পাশ ঘুরে দাঁড়াল... টস টস করে ঝরল ওর চোখের ক' ফোঁটা জল...। মা-কে দেখেছে ও কঠিন হাতে সব ঝড়-ঝাপটা সয়ে কাজ করতে ... এমন তরো আবেগ ভরা প্রাণে দেখে নি কখনও।

... তবুও সুন্দর ছিল মর্ণিং-শো, সুন্দর ছিল দিনটা।

***
ক্রমশ

পথে-ঘাটে ৪ ... বৌ-দি

পথে-ঘাটে


বৌ-দি

ভোর না হ'তেই কোথা থেকে সব হতচ্ছাড়া পাখিগুলো সার বেঁধে জড়ো হয়েছে- আর ওগুলোর দাপাদাপি দিল ত' সকালের স্বপ্ন-টাকে বরবাদ করে। আহা, ... "পাখি সব করে রব" ... যত্ত সব। সদ্য ঘুম ভাঙ্গা দিবাকরের সব রাগ টাগ গিয়ে পরল রবীন্দ্রনাথের ওপর। কি আর করা যায়! শনিবারের সকাল একটু টেনে ঘুমাবে তারও উপায় নেই ওই হতভাগাগুলির জ্বালাতে। যাক গে তাহ'লে নাহয় সকালের কাজটা করেই নেওয়া যাক্ ... তোয়ালেটা আবার গেল কোথায়? ... ওদিকে আবার দরজায় ঠক্-ঠক্। কি হ'ল সবাইকার... এই শনিবারের সাত সকালে!

- আরে ও দিগ্‌গজ বাবু দরজাটা খোল তো ... তোমার চা নিয়ে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব!

দরজাটা খুলতে খুলতেই বলল দিবাকর -
- ওঃ বৌ-দি, সরি, সরি ... বাঁচিয়ে দিলে তুমি আমাকে। চা-এর সাথে তোমার পায়ের ধুলোও দাও।
- তোমার জন্যে তা আর আনা হ'ল না। বৃষ্টি হচ্ছে ... সব ধুয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। কি করি!
- তা'হলে তোমার পায়ের ছাপটাই দাও না . বাঁধিয়ে রাখব।
- আরে, আমার পায়ের ছাপ দিয়ে তোমার কি হবে ... অন্য কারও থেকে যোগাড় করে নাও।
- ও বৌ-দি মনি, সে ছাপ কি আর কাগজে থাকবে! সে ছাপ তো আঁকবে মনে।
- তা-ই তো... কোন ফিল্ম-এর ডায়লগ হল এটা? নাও, চা-টা খেয়ে নাও ... ওটা ত' জল হ'তে চলেছে।
- তুমি দরজাটা ভেজিয়ে দাও না, গো! আমি বারান্দাতে বসে খেয়ে নিচ্ছি...
- হ্যাঁ, বুঝেছি .. চা-এর সাথে সিগারেট ব্রেক ফাস্ট! তোমার লাংক্স-টা গেল, আর কি।
- বৌ-দি, বৌ-দি, পরাও ফিলজফি ... এনাটমি জানলে কবে থেকে।
- বাঁদর! ইয়ার্কি হচ্ছে ... বলছি তোমার দাদাকে, তোমার ব্রেক ফাস্টের কথা। ...
- বোল না বৌ-দি, লক্ষী বৌ-দি টি।
- যাও... যাও!

মনে পরতে-ই ছ্যাঁত্ করে উঠল দিবাকরের বুকটা। সে পায়ের ধুলোও ধুয়ে গেছে ... সে পায়ের ছাপও পরে না আর ... কোথা-ও না। খাঁ-খাঁ কর উঠল মনটা।

শনিবার বন্ধ থাকত অফিস, একটু বেশী সময় মিলত উইকএন্ড-এ। একটু আলসেমি করা, বাজার করা, বৌ-দিকে জ্বালাতন করা তারপর চলত এদিক ওদিক আড্ডার আসর। সকাল থেকেই ঝিম ঝিম করে বৃষ্টি। কখন যে থামবে তার নেই কোনও ঠিক ঠিকানা, আজ বিকাল চারটায় আবার আমীর-দের বাড়ি যাবে... কথা দিয়েছে। ধুর, খেয়ালই হয় নি জিজ্ঞেস করতে বাড়িতে কে কে থাকে। নাই বা হ'ল, ... খোলা মনের লোক হবে হয়ত সবাই। নইলে কি আর দুম করে, বলতে গেলে প্রায় এক অচেনা অজানা লোককে, নিমন্ত্রণ করে বসবে! পথে সত্যনারায়ণ-এর মিষ্টির দোকানটা চোখে পরতে বেশী বাড়াবাড়ি না করে গোটা কয়েক চমচম আর সিঙ্গাড়া কিনে নিয়ে হাঁটা দিল।

আঃ, আমীরের ঠিকানার কাগজটা ভিজে গিয়েছে একটু - বাড়ির নম্বরটা ঠিকমত পড়া যাচ্ছে না। নামটাতেও কেমন খটকা লাগছে ... খান চক্রবর্তী! তা আর কি হবে খটকা লাগলে। এক ছোট ছেলেকে জিজ্ঞাসা করতেই বলল-
- ওঃ নাসিম মাসীর বাড়ি। ঐ ত' দুটৌ বাড়ির পরেই।
যাক বাবা - ওরা এখানে বেশ পরিচিত বলে মনে হচ্ছে।

কলিং বেল টেল নেই - দরজা নক্ করতেই এক ভদ্রমহিলা দরজা খুলে হাসিমুখে বললেন -
- দিবাকর বুঝি! এস ... তুমি করেই বললাম কিন্তু। আমি আমীর-এর মা।
- আর এ পাড়ার মাসীমা?
- ওরে বাবা, সে খবর দেখছি ইতিমধ্যে পেয়ে গিয়েছ!
- তাহলে আমিও আপনাকে মাসীমা বলব!
মিষ্টির প্যাকেটা নাসিম মাসীর হাতে দিয়ে দিবাকর মৃদুস্বরে বলল-
- আর মাসীমা, এ গুলো পথে পেয়ে গেলাম...

আমীর বসার ঘরে ঢুকতেই নাসিম মাসী -
- দেখেছিস দিবাকরের কান্ড!
- কী কাণ্ড-ফাণ্ডর কথা বলছ মা! দিবাকরকে তো বসতেই বল নি।
- আরে তাইতো.. ছিঃ ... তুমি বস দিবাকর। কথা বল তোমরা, আমি আসছি একটু বাদে।

বেশ ছিম ছাম বসবার ঘরটা। অতিরিক্ত আসবাবের বালাই নেই একদম ... একটা কাচের আলমারি। ঠাসা বই। আর একটা ফ্রেমে বাঁধান ছবি ... দিবাকরের উত্‌সুক দৃষ্টি নজরে এসেছে আমীরের।

- আমার বাবার ছবি। সুব্রত... সুব্রত চক্রবর্তী ছিল তাঁর নাম।

দিবাকর তাকাল আমীরের দিকে।

- সে অনেক দিনের কথা..., মানে আমি তখন খুব ছোট, আর জয়া আমার বোনটা তো ছিল আরও ছোট। উনি আমাদের ছেড়ে গিয়েছেন। আর আমাদের বড় করবার সব ভার বইতে হয়েছে মা-কে। একাই।

আরে দেখেছ জয়া ওর বইগুলি টেবিলটার ওপর ছড়িয়ে রেখেছে।

- আরে, তাতে হ'লটা কী! তোমার বন্ধু কি বইগুলো পরে ফেলবে... ক্ষতি কি তাতে, জ্ঞান বাড়বে। এই নাও চা নিয়ে এসেছি সবার জন্যে ... সার্ভ-টার্ভ কিন্তু তোমাদেরকেই করতে হবে।

টেবিলের ওপর ট্রে-টা রেখে। জয়া গিয়ে বসল ধপাস করে একটা চেয়ারে।

নাসিম মাসী এক থালা বোঝাই পেঁয়াজি আর কতগুলি ছোট প্লেট নিয়ে হাজির।
- এগুলো সব জয়ার করা।
- কি বলছেন মাসীমা... জয়া এ সব করতে পারে!
- মা, দেখেছ - দাদা-টা কাকে ধরে নিয়ে এসেছে। ... আঃ তোমার অত্তবড় নাম কিন্তু আমি বলতে পারব না। কী বলা যায়! ... দিবা। নাঃ দীপদা বলবো তোমাকে। রাজী তো!
- রাজী তো!... খুউব রাজী। দীপ ...ই আমার ডাক নাম... প্রিয় নাম।
- আরে দীপদা ... নামটা তো প্রিয় তা লোকটাকে ত' প্রিয় হতে হবে।

নাসিম মাসী হাসতে হাসতে ভর্তসনা সুরে জয়াকে বললেন
- তোর ঠোঁটটা কাটা... প্রিয় হতে হবে কী রে ... প্রিয় করে নিতে হবে যে।
- জয় হোক মাসীমার।

এই হাসি ঠাট্টা আর কয়েক দফা চা-পেঁয়াজিতে বিকেলটা কেটে গেল আর তারই সাথে সব দূরত্ব ... এক নিমেষে।

***

এরপর কতবার যে দিবাকর আমীরদের বা[ড়ি গিয়েছে ক' গ্যালন চা আর মুড়ি, তেলেভাজা শেষ করেছে তার হিসেব আর কে রাখতে যাচ্ছে। একদিন সন্ধ্যায় গড়িয়াহাটের রাস্তায় দিবাকরের সাথে ফুর-ফুর করে ঘুরে বেড়াবার সময় জয়া বলল...

- এই দীপদা, মাকে একবার টেনে হিঁচ্‌ড়ে বাড়ি থেকে বার করা যায় না! গোটা সপ্তাহ স্কুল, টিউশনি। তাছাড়া ক'টা গরীব ঘরের ছেলে-মেয়েকে ফ্রী-তে পড়াশুনা শেখায়। অবশ্য মা-র সময় না থাকলে বাচ্চা-গুলোকে আমরা একটু আধটু হেল্প করি। আসলে ওটা কিন্তু মা-কেই হেল্প করা। আর জান দীপদা ছেলে-মেয়েগুলি আমাদেরকে বেশ ভালবাসে। দাদা-টা একদম হাঁদা... ওর কোনও প্ল্যান-ফ্যান মাথায় আসে না।

- তোমার মাথায় বুঝি খুব প্ল্যান আসে?
- ঐ যে, তোমাকে বললাম ... বাড়ির একজন করলেই হল আর কি।
... বাড়ির একজন করলেই হল! হ্যাঁ, দীপকে ত' ওরা বাড়ির একজন-ই ভাবে, মানে তার বাইরে আর ভাবতেই পারে না।
- সিনেমা গেলে কেমন হয়!
- আরে দীপদা, তুমিও দেখছি বুদ্ধু ... মা বেরুবে আমাদের সাথে সিনেমা দেখতে। কি বুদ্ধি আমার ... পাগোল না, মাথা খারাপ!
- ও.কে. জয়া ট্রাই করে দেখা যাক না ... তারপর, না হয় দেখা যাবে বুদ্ধির ঢেঁকিটা কে! ... আরে, আর কতক্ষণ এই গড়িয়াহাট মোড়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেওয়া যায়!
- তাই তো, চল বাড়িতে চা খাওয়াবো।
- না, আজ থাক সেটা, তার চেয়ে চল বরং ঐ রেস্টুরেন্টটাতে এক কাপ চা আর একটা ভেজি-চপ মেরে দিই।
- আমি তাহলে প্রন নেব।

***

- ঐ তো ৫ নং বাসটা আসছে... আমি কাটছি দীপদা। তুমি কাল বিকেলে আসবে কিন্তু... অফিস থেকে সোজা।

- না, বাড়ি হয়ে আসব। বৌ-দি টা বসে থাকবে নইলে। ... চলি।

***

রাস্তা তেমন জ্যাম ছিল না, অফিস থেকে সকাল সকাল-ই ফেরা গেল। বাড়ি আসতে না আসতেই বৌ-দির হাতের চা এসে হাজির।
- বৌ-দি, আমি চা টা খেয়েই বেরিয়ে পরব, মানে এক্ষুণি ...
- আহা, ঘোড়াটা যে বেধে রেখে এসেছ, বুঝতেই পারছি। তা, কোথায় যাওয়া হচ্ছে দিগ্‌গজ বাবুর... শোনা যায়!
- আরে কোথাও না, ... ঐ জয়াদের বাড়িতে।
- জয়া! আজকাল দেখছি ঘন ঘন জয়া... জয়ার জয়ধ্বনি নাকি!
- আরে, দ্যুৎ বৌ-দি, কি যে বল। ওরা আমার দারুন বন্ধু... ও সব কিছু নয়। কিছু থাকলে তোমাকে বলব না - তাই হয় না কী!
- তাই বুঝি?
- তাই তো, বৌ-দি তো বন্ধু ... "এমন বন্ধু আর কে আছে?..."
- আঃ বড় ফাজলামি তোমার ...সব সময় সিনেমার ডায়লগ!
- ফাজলামি! বৌ-দি মানে কি জান! বস, আরে বস না বৌ-দি ... বলছি তোমাকে, মন দিয়ে শোন, একদম মন দিয়ে শুনবে কিন্তু। বৌ-দি হচ্ছে... একটা মানুষের মধ্যে বন্ধু, ভাই, বোন, দিদি এমন কি মা-ও, হ্যাঁ মা বলো বন্ধু বল সব কিছু।... আর.

... নজরটা পড়ল বৌ-দির দিকে... ফ্যাঁত ফ্যাঁত করে কাঁদছে।

- কাঁদছ বৌ-দি!
- নারে বোকা, কাঁদছি না ... এটা আনন্দ। হাঁদারাম কোথাকার!! যাও এখন তাড়াতাড়ি ফিরবে কিন্তু।
-আচ্ছা... চেষ্টা করব।

***

... ক্রমশ

পথে-ঘাটে ৩ ... তেলেভাজা

পথে-ঘাটে



তেলেভাজা

রাত হয়েছে অনেক। কেন যেন দিবাকরের ঘুম ভেঙ্গে গেল, ট্রেনের ঝাঁকুনিতেই হবে। বাইরে আলো-আঁধারের লুকোচুরি চলছে। চাঁদনী রাত কিন্তু এ চাঁদ এক লাজুক মেয়ের মত থেকে থেকে ঘন মেঘের ওড়নার অন্তরালে তার হাঁসিটাকে লুকোবার চেষ্টা করছে। আবার কখনও মুচকি হেসে আকুল করছে প্রেমিক প্রেমিকার কল্পনা-জগতকে। আকাশ ছড়ানো মেঘের দল জোট বেঁধেছে এলোমেলো হাওয়ার সাথে, মেতে উঠেছে সকলে লুকোচুরি খেলায়। দুই-এক ঝাপটা বৃষ্টিও হয়েছে মনে হয়, আলো-আঁধারে ঝিলমিল করছে লাইনের ধারে সার দিয়ে দাঁড়ানো গাছের বারিসিক্ত পত্ররাশি। আলো-আঁধিয়ার খেলার পর্ব শেষ হয়নি এখনও ... রাত এখনও বাকি।

কোথাও মেঘাচ্ছন্ন অম্বর হার মানিয়েছে চাঁদটাকে সেই লুকোচুরি খেলায়... আঁধারের কোলে বিলীন হয়েছে আকাশ আর মাটির দূরত্ব... নেই কোনও দিক আর দিগন্ত। গ্রামগুলি কোনও অব্যক্ত বেদনা গোপন করতে পিছিয়ে পড়ছে পথের মাঝে। তারই অশ্রুসঞ্চিত বারিধারা ক্ষীণবেগে বইছে আঁধারের বুকে মৃদুস্পন্দন জাগিয়ে। দৃষ্টিগোচর না হলেও স্পর্শ করে সে স্পন্দন অনুভূতিকে ... তার ঢেউ জাগায় হৃদয়ে দোলা...আলো-আঁধারের অস্ফুট হাতছানির নীরব আকর্ষণ নিয়ে চলে দূরে, বহু দূরে। ব'য়ে আনে স্মৃতির উৎস হ'তে কখনও আনন্দ কখনও-বা বেদনা-জড়িত পরশ। এ-তো নয় শূন্যতা ... এ হ'ল বলা আর না-বলা কথার গ্রন্থিত ছন্দ।

হেথা-সেথা রাতের সে মৌনতা ভঙ্গ করা ঝিঁ-ঝিঁ পোকার মুখরতা ... তবুও হয়না ছন্দপতন।

কোথাও... হাজারো জোনাকি এক টুকরো তারকাময় আকাশের মত ছেয়ে আছে বনানী, ... মিলনপ্রয়াসীর তৃষ্ণা জাগিয়ে। এ এক অদ্ভুত দৃশ্য। যেন আঁধারের বুকে ছড়ানো রাশি রাশি খসে পরা তারা আঁধারঘন গ্রামগুলিকে মৃদু আলোকের বরণ ডালিতে মনোরম করে তোলার প্রচেষ্টারত। আলো-আঁধারের প্রণয়ের মৌন নিবেদন।

ট্রেনের কামরার রাতের আলো জ্বলছে পিট-পিট করে, প্রায় সব যাত্রীরা নিদ্রামগ্ন। যাত্রীরা তাদের বাক্স-পেঁটরা সব শিকল-তালাবদ্ধ করে বাক্স হারানোর চিন্তা থেকে খালাস। কোথাও এক-দুই বাচ্চা কারণ অকারণ ট্যাঁ-ট্যাঁ করছে। কিছু যাত্রী জায়গা না পেয়ে কামরার মেঝেতেই শুয়ে পড়েছে, খবরের কাগজ বিছিয়ে। ট্রেনে দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় এসব এখনও বরদাস্ত করা হয়। আর এতে কারই বা ক্ষতি! ট্রেনই তো দেশের সব স্বল্পবিত্ত্বের সাধারণ মানুষের একমাত্র পরিবহন। ট্রেনের সংখ্যাও পরিমিত তাই এ সহনশীলতার সমালোচনা নিষ্প্রয়োজন।

গাড়ির দোলা ঘুমের আবেশে জড়িয়েছে সবাইকে। রাতের প্রহরীরা টহল দিচ্ছে মাঝে মাঝে, তাদের বন্দুক পিঠে ঝুলিয়ে।

ঘুমটা সম্ভবতঃ আর আসবে না। দিবাকর চেয়ে আছে বাইরের দিকে... আঁধারটা ঘনিয়ে আছে এখনও, নেই কোথাও এক ছিটে আলো। এক বহু পরিচিত গানের কথা মনে পড়ছে... "অন্তরেতে দেখবো যখন আলোক নাহিরে ..." রবি ঠাকুরের গান এটা... যে গেয়েছিল তাকে দিবাকর দেখতে শুরু করেছিল, "...চোখের বাহিরে" আর "অন্তরেতে..."।

গ্রাজুয়েশন-এর পর শুরু করেছে একটা ইন্টারন্যাশানাল কোম্পানিতে এক্সীকিউটিভ ট্রেনী হিসেবে। বন্ধুর কমতি ছিল না ওর কোনও দিন... আর তারই সাথে ছিল ফটোগ্রাফীর ঝোঁক্। টালীগঞ্জের ফিল্ম-স্টুডিও পাড়ার ছেলে, ফিল্ম পেত অঢেল। বন্ধুরাই যোগান দিত তার - তাই ছবি তুলবার কৃপণতা ছিল না একদম। অবসর সময়ের অনেকটা কাটত বন্ধুদের সাথে কফি-হাউসের আড্ডাতে, এদিক বন্ধু-বান্ধবীদের বাড়ির চা, ঝাল-মুড়ি আর পেঁয়াজীর আসরে। আরে শুধু কি চা, অনেক সময় মা-মাসী বা বোন, বৌদি-রা ভাল-মন্দ না খাইয়ে ছাড়ত না একদম-ই। একবার কোনও বাড়িতে পা মাড়ালেই হ'ল... বলে না, কোনও বাড়িতে আসাটা নিজের ইচ্ছায় - কিন্তু যাওয়াটা নয়। তাই-ই হ'ত। সব পরিবারে ত' আর অন্নপূর্ণার ডালি থাকে না - তবুও টানা-টানির দিনেও, আকালের কালেও নিজের খাবার ভাগ করে খায় অতিথির সাথে ... এ যে এক অলিখিত প্রথা। খাওয়ার থেকে খাওয়ানোর আনন্দ মেয়েদের, এ তো রয়েছে দেশের প্রতিটি ঘরে। সত্যি বলতে কি, এই আদরে ডাল-ভাতকেও অমৃত বলে মনে হয়। নাই বা হ'ল বিরিয়ানী, ফ্রায়েড-চিকেন... মা-মেয়েদের আন্তরকিতায় তাদের হাতের ছোঁয়ায় সব কিছুই হয়ে ওঠে যেন পরমান্ন। ওদের গড়িয়ে দেওয়া এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল আনে র‌্যালি সিং-এর লস্সীর থেকেও বেশি তৃপ্তি। অন্ততঃ দিবাকরের তো তাই মন হ'ত।

এরই মাঝে, দিবাকর সপ্তাহের দুটো দিন টুক্ করে কেটে প'রত ক'টা ঘণ্টার জন্যে। এ সময়টা ছিল ম্যাক্স-মূলার ভবনে জার্মান ক্লাসের জন্যে বাঁধা... ভাষার সাথে ছিল হয়ত ওখানে আরও অন্য কিছুর টান। ... যাক্, সেটা আবার পরে কখনও তলিয়ে দেখা যাবে।

মোট কথা দিনগুলি ছিল প্রোগ্রাম-বিহীন প্রোগ্রামে ঠাসা মানে যাকে বলে - প্যাক্ড্-আপ।

এরই মাঝে এলো বড়দিন - পঁচিশে ডিসেম্বর। হৈ-হুল্লোড় করে চারজন বন্ধু মিলে যাওয়া হ'ল চিড়িয়াখানায় ... ফটো তোলার নাকি দারুণ ব্যাকগ্রাউন্ড। হ্যাঁ, গেট পেরিয়ে ঢুকতে না-ঢুকতেই ব্যাকগ্রাউন্ড-এর উদয়... চপলতা উচ্ছ্বসিত হাসি আর কলরবে মাতিয়ে জন পাঁচেক কলেজ ছাত্রীর প্রবেশ দৃষ্টি আর শ্রবণীর আকর্ষণ করেছে সেকথা বলাই বাহুল্য।
***
বেশ চলছিল ট্রেনের ঝাঁকুনি আর দোলা, ... তা মোটামুটি ভালই লাগছিল। এ দোলার আবেশেই হবে হ'য়ত, সব যাত্রীগুলো.. ঐ হ'ল, সবাই না হোক, বেশীর ভাগ... হ্যাঁ, প্রায় সবাই ঘুমচ্ছে বেহুঁশের মত। আর ফেলে আসা দিন দিনগুলি সুযোগ পেয়ে ঘুর-ঘুর করে লাইন মারছে দিবাকরের স্মৃতির দুয়ারে। একবার এ দুয়ার খুললেই হ'ল... হুড়-মুড় করে স্মৃতিগুলো... না, আর ঢুকবার অবকাশ পাবার আগেই - ক্যাঁর-খ্যাঁর করে ব্রেক মেরে থেমে গেল গাড়িটা... রেড সিগন্যাল হবে হয়ত।

একটু যে তন্দ্রার ভাব এসেছিল, তাও উবে গেল - নিঃশেষে।

বাইরে এখনও অন্ধকার, টিপ-টিপ করে বৃ্ষ্টিও পড়ছে। ট্রেনের জানালাটা ভিজে রয়েছে, কামরাটাতে ভেপসা গন্ধ, ফ্যানগুলো সব ঘুরছে ঠিকই কিন্তু জানালাগুলি বন্ধ থাকলে এর কি আর কোনও সুরাহা হয়! যাকগে, ট্রেনটা থামায় একটু নিস্তার ত' পাওয়া গেল - মন্দেয় ভালো।

... বর্ষণমন্দ্রিত কলকাতার সে দিনগুলির আবেশ এখনও মলিন হ’য়ে বিলীন হয়নি অতীতের আঁধারে। সারাটা দিন রিম-ঝিম বারীশ, মেঘের ঘনঘটা আর তারই ফাঁকে ফাঁকে কখনও লাজুক অরুণ-কিরণ; সিক্ত সরণী – এথা হোথা পীচ ভাঙ্গা রাস্তায় জমে থাকা ঘোলা জল, বাসে ট্রামের ভিড়ে গুঁতো-গুঁতি, কোনায় কোনায় হরেক রকম সোঁদা সোঁদা গন্ধ। এদিক সেদিক পথধারে ফুলের ব্যাপারি —জুঁই আর রজনীগন্ধার সৌরভ । সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বিলিয়ে চলেছে মেয়েদের কবরীর সিক্ত যূথিকা তার আবেশভরা সুবাস। বষর্ণমুখর দিনশেষে পথের ধারে ছাপরা থেকে ভেসে আসা তেলেভাজার গন্ধ... লোভনীয় সে আকর্ষণ উপেক্ষা করার উপায়টা খুঁজে পাওয়া খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়!! পথপ্রান্তে তেলেভাজার বাস বশ করেছে সকল ঋতুতেই — শীতের কুয়াষাচ্ছন্ন সন্ধ্যায় মুখরোচক সে ভাজা আর্দ্র করে তুলেছে মুখটা বারংবার; আঃ – তুলনাহীন ... হ্যাঁ ঐ চার-পাঁচটা তারা ঝোলানো আর জেল্লা ধরানো রেস্টুরেন্টগুলিও সে তৃপ্তি যোগাতে পারবেনা, একথা কিন্তু হলপ করে বলা চলে।

এমনই এক ঝিম্-ঝিমে বৃষ্টিঝড়া সন্ধ্যায় বাস স্ট্যান্ডের পাশের ঐ নামকরা তেলে ভাজাওয়ালা দৃষ্টিগোচর হওয়া মাত্রই রোশনি-ইন্দ্রিয় সাড়া দিয়ে উঠল - তা হবে না! ওর ভাজার জন্যে হরদম ভীড় থাকে। এই বৃষ্টিতেও দাঁড়িয়ে আছে গোটা-কয়েক ছেলে-মেয়ে লোভ সামলাতে না পেরে। এক ঠোঙা গরমা গরম তেলেভাজা... দামটা দিতে গিয়ে দশটা পয়সা কম পড়ছে। কি আর করা যায়... দশ টাকার নোটটা বার করতেই- ভাজিওয়ালা নারাজ।

- দশটা পয়সার জন্যে দশ টাকার ভাংতি দিই ... এ কেমন কথা হ'ল, বলুন তো।
- আরে, আমার যে আর ভাংতি পয়সা নেই - তা হলে একটা ভাজি কমিয়ে দিন...

পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা হাওয়াই শার্ট পরা ছেলেটা, তার জন্যে এগিয়ে দেওয়া ঠোঙাটা নিতে নিতেই বলে উঠল -
- নাঃ, কমাবার দরকার নেই... ঐ দশটা পয়সা আমিই দিচ্ছি।
- বা, রে! তুমি কেন দেবে!
- তোমার ওই দশ পয়সার জন্যে দশ টাকার ভাংতি তো কোথাও মিলবে না। পাশের ওই চা-এর দোকানটাতে গিয়ে বস ত' দেখি... আমি আসছি দামটা মিটিয়ে। তখন সব হিসেব নিকেশ হবে।
অগত্যা দিবাকর গিয়ে বসল একটা বেঞ্চে ... তেলেভাজাটার ঠোঙা হাতে। দু-গ্লাস চা-এর অর্ডার দিয়ে ছেলেটা, মানে হাওয়াই-শার্ট পরা যুবক-ছেলেটা এসে বসল দিবাকরের মুখোমুখি মানে উল্টোদিকের বেঞ্চে।

- বাঃ, তুমি ত' আবার চা-এর অর্ডার দিলে ... দামটা দিই কি ক'রে! আমার তো...।
- দশ টাকার নোট! এই তো! ভাঙ্গতে আর হবে না ... পয়সাটা আমিই দিচ্ছি। ভাজির সাথে চা না হলে কি আর ভাল লাগে!
- হ্যাঁ, ঠিক তা ব'লে...
- আরে, ঠিক আছে, ঠিক আছে ... যদি তোমার আঁতে ঘা লেগে থাকে, তাহলে আমার বাড়ি গিয়ে হিসেবটা মিটিয়ে দিয়ে আসবে।
আমার নাম আমীর... এই আমার ঠিকানা - যাদবপুরে ....

একটা কাগজে খস্-খস্ করে ঠিকানাটা লিখে দিবাকরের হাতে ধরিয়ে দিল। কাল শনিবার, বিকেল চারটে নাগাদ চলে এস।
লোভে পরে অনেকগুলো ভাজা কেনা হয়ে গিয়েছে। কাছেই দুজন বাস কন্ডাক্টর চা খাচ্ছিল। ভাজির ঠোঙা দুটো এগিয়ে ধরে বলল..

- ও, দাদা! তেলেভাজা খাবেন! আমাদের খুব বেশী হয়ে গিয়েছে।
- কি হ'ল পারছেন না, নাকি?
- না, খুব পারছি, কিন্তু বাড়িতে যে অমৃত পরে আছে ... সে গুলোর কি হবে?

বাড়িতে মেয়েরা খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে তাদের প্রিয়জনের ঘর ফিরবার পথ চেয়ে। ভাল-মন্দ কিছু রান্না হয়েছে সারাটা সন্ধ্যা জুড়ে - কয়লা অথবা কাঠ-খড়ির ধোঁয়াতে চোখ কচলাতে আর চোখের জল ফেলতে ফেলতে। চপ-কাটলেট না হলেও ও খাবার না খেয়ে কোনও উপায় নেই। নইলেই, হ'ল আরকি - মান-অভিমান, চোখের জল, যেন জ্যান্ত মানুষটার আস্ত হৃৎপিণ্ডটা টেনে-হিঁচড়ে বার করা হ'য়েছে... এই তো ব্যাপার। সব বাড়িতেই চলছে এসব ... মানে, যে সব পরিবারে আধুনিক সাহেবিয়ানার ঢুকবার সুযোগ এখনও মেলে নি। তা, এ কথা ওই কন্ডাক্টরদের-ও অজানা ছিল না ...

- দিন তা হ'লে ... ধন্যবাদ...

চা, মানে কন্ডেন্সড মিল্ক আর চিনির সুপের গ্লাসে শেষ চুমুকটা দিয়ে হাঁটা দিল' ওরা বাড়ির দিকে।
- তা হলে কাল বিকেলে ...
- ও. কে.

***

ক্রমশ

Monday 12 October 2009

শান্তির নোবেল পুরস্কার ২০০৯

নোবেল কমিটির সিদ্ধান্ত ইউ.এস. প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা-কে ২০০৯ শান্তির নোবেল পুরস্কৃত করা সমগ্র বিশ্ব এমন কি স্বয়ং বারাক ওবামা-কেও বিস্মিত করেছে। ওবামা মাত্র নয় মাস হ'ল ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট-এর চেয়ারে, শান্তির জন্য এখন অবধি তার কোনও বাস্তবিক অবদান নেই। এ কথা ঠিক ... আপাতদৃষ্টিতে এই পুরস্কার ঘোষণা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে করা হ'য়েছে। তাই এ খবরটা হজম করতে দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষদের কিছুটা সময় প্রয়োজন হবে, সন্দেহ নেই। আর এতে, অর্থাৎ এ সন্দেহ বা স্বীকৃতির ইতস্তত-তাকে অবান্তর বলে আখ্যা করাও সমুচিত হবে বলে মনে হয় না। ইউ.এস. আমেরিকার কার্যকলাপ এতদিন ধরে সমগ্র বিশ্বে সন্ত্রাস আর অশান্তি এবং হিংস্রতার আগুন জ্বালিয়েছে। তাই এই অবিশ্বাস, অনাস্থা অস্বাভাবিক অথবা ভিত্তিহীন নয়।
অন্য দিকে. জর্জ বুশ- ডিক চেনী-এর আগ্রাসী নীতির অবসান ঘটিয়ে পৃথিবীতে শান্তির আবহাওয়া আনা - এখন পর্যন্ত মৌখিক হলেও... যুগান্তরিক।
দুর্ভাগ্যক্রমে, আর্থিক এবং সামরিক বলে পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী এ দেশ আর তার সকল নেতাবৃন্দ বিশ্ব-সংস্থা, রাষ্ট্র-পুঞ্জকে ভাঁওতা দিয়ে, মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে গোটা দুনিয়ার মত অগ্রাহ্য করে আক্রমণ করেছে একাধিক দেশকে তছনছ করেছে বিশ্বশান্তি। "আমাদের সাথে - অথবা আমাদের বিরুদ্ধে" এই বুলিতে বাধ্য করছে অনেক দেশকে তার আক্রমণাত্মক নীতির অংশীদারি হতে। আর আজ ঐ দেশের-ই প্রেসিডেন্ট চেষ্টা করছে তার দেশটাকে অহঙ্কারের উচ্চাসন থেকে নামিয়ে বিশ্বসভায় সবাইকার সাথে সম উচ্চতার বৈঠকে বসতে এবং সমস্যার সমাধান বেওনেট আর বোমার পরিবর্তনে আলোচনায় খুঁজতে। এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত এ চিন্তা ছিল কল্পনাতীত। যদিও এখনও এটা শুধু মৌখিক, তবুও বিশ্ব-রাজনীতিতে পরিবর্তনের পূর্বাভাষ। অন্ততঃ সেটাকে জানানো হ'ক স্বাগত... শান্তির জন্য নব উদ্যমে অগ্রসর হ'তে - দেওয়া যাক ওবামাকে সুযোগ। চেষ্টা করা যাক শান্তির মেরুদণ্ড সবল করতে। সফল হলে মানব-জাতির সফলতা ... নইলে শুধু একটা পুরস্কারের অপচয়। ... সান্তনা থাকবে ... চেষ্টা-টা তো হয়েছিল!
আর, সাহিত্য... তা-ও তো শুধু বলা কথা, কাগজের লেখা... তাতে-ও নোবেল পুরস্কার হয়!

Tuesday 15 September 2009

Chhayabrita ছায়াবৃতা

ছায়াবৃতা

পরাধীনতার অবসান হয়েছে... বিদেশী প্রভুত্ব খতম হয়েছে অনেকগুলি দশক , কিন্তু খতম হয়নি আভিজাত্যের মিথ্যা অভিমান। আজও রয়েছে জাত-ভেদ, আজ পর্য্যন্তও নারী-স্বাধীনতা স্বীকার করতে নারাজ আমাদের দেশের সব সমাজ। মজ্জ্বায় মজ্জ্বায় জড়িত কু-শিক্ষা, কু-প্রথা। হায়রে তার পরিনাম মেয়েরাও প্রায় বিনাপ্রতিবাদে স্বীকার করে নিচ্ছে আজও এই ঘুনধরা সমাজের অন্যায় অবিচারের কু-প্রথা। দুর্ভাগ্যের কথা, শুধু মাত্র স্বীকার করা নয়, এ সমাজের মেয়েদেরই এক বড় সংখ্যা প্রত্যক্ষ আপ্রত্যক্ষ ভাবে অংসীদারী নারী-স্বাধীনতা হরন এবং নারী-পীড়ন-এর।

স্বামী, শ্বশুরের কর্তৃত্ব তো রয়েছেই আর তারই জুটি শ্বাশুরী-ননদের যাতনা অর্থাত্‍ গোদের ওপর বিষফোঁট আরকি। আজও মাছের বড় টুকরোটা পায়না বাড়ীর মেয়েটা, পরে ছেলের থালিতে... আর সেটা আসে মা-এর হাত থেকে। ... স্নেহময়ী মা। হায়রে ছায়াবৃতা নারী, মাতৃস্নেহেও পক্ষপাতিত্ত্বতা, বৈষম্যমূলতা ... যুগ-যুগের কু-শিক্ষা আর বিকৃত সংস্কৃতির ফলবিশেষ।

নারী-পুরুষের আইনগত সম-অধিকার অবশ্যই বর্তমান, কিন্তু ঘুনধরা সমাজের অন্ধতাপূর্ণ আদিম দৃষ্টিভঙ্গী আদালতের কানুন দ্বারা পরিবর্তন করা বাস্তবিকপক্ষে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কুসংস্কারাচ্ছন্ন মধ্যযুগ আজও এই একবিংশ-শতাব্দীতে আমাদের দেশে প্রতি নিয়ত উপস্থিত... এ কথা অবিবাদিয়।
যতদিন সামাজিক বিপ্লব দেশের প্রতিটি কোনে, ঘরে-ঘরে সমাজের প্রতিটি স্তরে জাতি-ধ র্ম, পেশা এবং স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে নূতন, উন্মুক্ত, উদার চিন্তাধারা পৌঁছে না দিয়েছে তথাবধি সামাজিক স্বাধীনতা স্বপ্নাতীত।
পৃথিবীর অনেক দেশে পুরুষপ্রাধান্য অবলুপ্ত হয়ে নারী-পুরুষের সামাজিক সমাধিকার স্বাভাবিকতার স্তর স্পর্শিত করেছে ... আমাদের দেশের সব মেয়েরা কি এই সামাজিক সমাধিকার, সামাজিক স্বাধীনতার অযোগ্য?

লোকদেখানো প্রগতিশীলতার অভিনয় করাটা এক ফ্যাশনের সামিল, ওষ্ঠে প্রগতির বুলি ... কিন্তু সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। এই লজ্জ্বার কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই।

... এ সব কিছু শুধুমাত্র সরকারী রাজনীতিমূলক প্রশ্ন নয়, এটা মূলতঃ সমাজিক প্রশ্ন। কেবলমাত্র সরকারকে দোষারোপ করে, সমাজের অপকর্মে আপন ভূমিকাকে অস্বীকার করে সামাজিক অবিচার, অনাচার-এর দায়ীত্ব থেকে মুক্ত হবার প্রচেষ্টাটা খুবই সহজ... সামাজিক উন্নতির কন্ঠরোধ এখানেই।

লেখনী ... প্রসূনের প্রতি

প্রসূন...

কলকাতা থেকে জার্মানীতে ফিরেছি ক'টা দিন আগে। মেয়ে নাটাশা আর ওর বন্ধু রথিন-এর সাথে পরিচয় হ'য়েছে তোমার ... তোমার কথা বলতে ওরা উচ্ছ্বসিত। আরে না, না আমি ওদেরকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করিনি। লোকদেখানো আভিজাত্য তোমার নেই ... তোমার অকৃত্রিম আন্তরিকতা, সাহজিকতা ওদেরকে মুগ্ধ করেছে।

জানোই-তো ভারতের মধ্য-সম্প্রদায়ে পরিবারে পরিবারে চলছে এখন কৃত্রিম আভিজাত্যের রঙ্গমঞ্চ-প্রদর্শন প্রতিযোগিতা। একটুকু সুযোগ মিললেই হ’ল আর কি,... সুরু হয় তখন এদের সু-নিপুন রঙ্গ; হ্যাঁ ঠিক কথা, কৃপণতা নেই এদের ন্যাকামীর পরিবেশনে। সে তো অন্নপূ র্ণার ভান্ডার, ডালিটা যে সব সময়েই ভরা থাকে কৃত্রিমতায়। সার্থকতার আপন গুনগানের ফুলঝুরি অনির্বান।

বিত্তবান ধনীশ্রেনীর কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, মথ্যসম্প্রদায়ের এই অংশ করে ধনতন্ত্রের তাঁবেদারী... তথাকথিত সভ্যতা-সংস্কৃতির বড়াই করতে শতমুখ কিন্তু জড়তা আসে এসব সাহেব-সাহেবাদের সাধারন আর খেটেখাওয়া নিম্ন-পারিশ্রমিকের মানুষদেরকে একটুকু মর্য্যাদা দিতে, এদের দম্ভের প্রাসাদ ভেঙ্গে পরে এতে।

কি সে সভ্যতা যেখানে সমাজের এক বৃহত্‍ অংশকে ছোট করে দেখা হয়, আজও আখ্যা দেওয়া হয় “ছোট-লোক”, তুই-তোকারী ছেড়ে ওদেরকে আপনি বলে কথা বলতে পাষানসম হ’য়ে ওঠে সাহেব-বিবীদের জিওহ্বা, মানবিকতার নেই এক ফুটো-পয়সা মূল্য!

মাঝে-সাঝে আমাদের ভারতে যাওয়া হয়, সবাইকার সাথে দেখা করার ইচ্ছেটা অপরিপূর্ণই থাকে প্রতিবার।
কলকাতা যাওয়ার আকর্ষন তো রয়েছে কিন্তু ব্যাপারটা আমার কাছে কিছুটা মর্মান্তিকও বটে। ওই শহরে আসবার জন্যে ধর্-ফর করে এখনও মনটা আমার ...
আর সেথায় পৌঁছুবার পর ... অবস্থা হয় আপন ভিটে-বাড়ী থেকে উত্‍খাত হওয়া উদ্বাস্তু সামিল।

আবার দৃষ্টিগোচর হয় কৃত্রিমতা আর পদদলিত মানবকিতা। ... এটা শুধু কলকাতায় নয়... চলছে গোটা দেশ ধরেই। একথা তো তোমারও অজানা নয় - তবুও লিখছি।

শুভেচ্ছান্তে

প্রবাসী

Monday 14 September 2009

পথে-ঘাটে ২

পথে-ঘাটে ২

চা-ওয়ালা
ট্রেনটা চলেছে শহরতলীর মাঝ দিয়ে ... ঘুট-ঘুট করে, মন্থর গতিতে হেলে-দুলে। এক ধারে নগরীর অট্টালিকা, বিলাসিতার প্রাচুর্য্য, তারই পাশে এ বস্তি, অস্তিত্বের লড়াই, শুধুমাত্র টিঁকে থাকে নিয়ে ধাক্কা-ধাক্কি। এ যেন আলো-আঁধারের সহবাস। আঁধার বিনা আলোর কি কদর থাকে? তা-ই ভাঙ্গা ছাপড়া, বস্তি না থাকলে অট্টআলিকার বিলাস-নিবাসের পানে কি আর কেউ চেয়ে থাকত ঈর্ষা জড়িত দৃষ্টিতে? ... আরে না-না, ঈর্ষা জড়িত দৃষ্টিতে ক্ষতি কোথা? এই-ই তো সচ্ছ্বল গোষ্ঠীর মলম, প্রাচুর্য্যগলিত হৃদয়ে ঈর্ষা-ই উপযুক্ত মলম।
আরে দেখে দেখে সবাইকার সয়ে গিয়েছে, নইলে মগজটা বিগড়ে যেতো হয়ত।
বস্তিগুলি পিছনে রেখে ট্রেনটার গতি একটু বেড়েছে, এখন খোলা মাঠ আর গাছগুলো হু-হু করে ছুটে চলেছে পিছু পানে, এগিয়ে চলেছে যাত্রীসকল।
চ-কফির কেটলী নিয়ে হাঁকা-হাঁকি করছে হকারগুলো
“কফি ... কফি: চায় গরম...”।
“এই-যে ভাই একটা চা দিন তো”।
কার উদ্দেশ্যে বলা হ’ল কথাটা ... চা বিক্রেতা ঠিকমত উপলব্ধি করে উঠতে না পেরে একবার ঘাড়টা ঘুড়িয়ে ফ্যাল-ফ্যাল করে চাইল বক্তার প্রতি। ভালো পরিষ্কার পোষাক পরা এক লোক, তার দাঁড়িটা আবার সৌখিন ভাবে কাটা ... আরে ছাই, এ কার ম’ত হবে দাঁড়িটা! উঁ-হুঁ, মনে পড়ছে না ঠিক মত, দুত্তোর দাঁড়ি তো আছে অনেক বাবুদের ... এতো আজকাল স্টাইল। এ বাবু-লোক কি এক সামান্য ফেরিওয়ালার সাথে ভদ্রভাষায় আপনি-টাপনি ক’রে কথা বলবে! আরে ও তো সাত জন্মেও শোনেনি বাবু-সাবদের কাছ থেকে আপনি ক’রে সম্বোধন করতে। তুই-তোকারি শুনতে অভ্যেস হ’য়ে গিয়েছে। ... শুধু কি এই বাবুরা! ওদের বাচ্চা-কাচ্চাগুলোও ধার ধারেনা সামান্য একটা ভদ্রতার, হ্যাঁ-হ্যাঁ, ওরা তো ভদ্দর-সমাজের তাই হুকুম করাটা যেন জন্মগত অধিকার।
না, শুনতে ভুল হ’য়ে থাকবে, ভাবলো চা-ওয়ালা ...
“কি চা আছে নাকি, দিন তো এক কাপ”।
এইতো ঠিকই শুনেছে, এত দিন বড়-ছোট নির্বিশেষে সবাইকে বলেছে আপনি ক’রে, আজ অপ্রত্যাশিতভাবে এক বাবুর মুখে এই সম্বোধন যেন অবিভূত করে দিল ওকে।
“হ্যাঁ-হ্যাঁ, আছে বৈকি, দিচ্ছি এক্ষুনি”।
সযত্নে ভ’রে দিল ছোট প্লাস্টিকের পাত্রটা কানায় কানায়; হাতে গরম লাগতে পরে ভেবে আবও একটা প্লাস্টিক লাগিয়ে দিল চা-পাত্রটার বাইরে।
“দেখবেন গরম আছে চা-টা”।
“সুক্রীয়া”।

... মানে ধন্যবাদ? এ কি হ’ল! হুকুম শোনার অভ্যস্থ কানে লাগছে এসব যাদুর মত। চা-এর চারটে টাকা কেটে বাকী টাকাটা ফেরত্‍ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় ঘাড় ফিরিয়ে দাঁড়িওয়ালা বাবুকে আরও একবার দেখে নিল। বাড়ী গিয়ে বৌ-টাকে বলতে হবে কথাটা।
হ্যাঁ,বৌ-টাকে ভালোকিছু বলবার মত তো কিছুই থাকে না কোনও দিন। থাকবেই বা কিভাবে! গোটা দিন ধরে এই ট্রেনে ট্রেনে ফেরি করে অনেক রাতে ডেড়া ফিরে মেজাজটা হ’য়ে থাকে ঐ চা-কেটলীটার মতই গরম। সারাটা দিন অনেক বাবুলোকের দুর্ব্যাবহার হজম করে বাড়ী ফিরে বৌ-টাকে একটু পেটালেও রাগটা কমে, গরম মেজাজটাতে একটু ঠান্ডা জলের ঝাপটার মতই লাগে। কেন যে পেটায় সে তা নিজেই জানে না, অনেকটা অভ্যেসের মতই হয়ে দাঁড়িয়েছে এটা।
অনেক দিন মানে অনেকগুলো বছর কেটেছে বৌটা ঘরে এসেছে। কেন যেন মনে পরে গেল। বিয়ে-ফিয়ে করবার ভাবনা হ’ত-ই না তখন ওর। এদিক ওদিক আড্ডা দিত অন্যসব ছোঁড়াদের সাথে, লুকিয়ে বিড়ি ফুঁকতে শুরু করেছে সবেমাত্র। ব্ল্যাকে সিনেমার টিকিট বিক্রী করতে শিখেছে ইদানিং, এতে চলে যেত মোটামুটিভাবে মাঝে-সাঝে রাস্তার ধারে অথবা পার্কের ঐ কোনটিতে গোলগাপ্পা গিলে নিয়ে বিড়ি ধরাবার খরচাটা।
বাপের পকেট মারবার কথা ভাবলেই রাগ হ’ত ওর, বাপের ঐ হাজারটা তালিমারা শতছিন্ন জামার পকেটে কিছু থাকলে তো সে প্রশ্ন আসতো। আর পকেটে থাকবেই বা কি ক'রে? বাপ, কাছের রেলস্টেশনে মোট বইত, তাও আবার বে-আইনিতে। কুলির লাইসেন্স ছিলনা, তাই বেশী পয়সাও চাইতে পারত না। যা-ও বা পেত তর ওপরেও ভাগ বসাত অনেকে। কি আর করবে ও হতভাগা, স্টেশনে টিঁকতে গেলে এটা তো আছেই।
এতে তো আর মুখের ভাত জোটেনা দু-বেলা, তাই ওর মাকেও রোজগার করবার ধান্ধা করতে হ’ত। আশে-পাশে বাড়ী তৈরির কাজে ইঁট, সিমেন্ট আর ঝুড়ি বোঝাই মাটি বওয়া, মানে যোগাদারির যত' সব কাজ।
এই করেই চলছিল কোনওমতে দিনগুলি। গাঁয়ের এক লোকের প্রস্তাব বাপের কাছে বেশ মনঃপুত হ’ল, পাঁচশো-এক টাকা হাতে গুনে নিয়ে ছেলের বিয়ে ঠিক হ’ল সে লোকটার মেয়ের সাথে। বিহারে, পাটনার কাছাকাছি হবে... আরে কাছাকাছি মানে দূর কোনও গ্রামে ... ঐ ধ্যার-ধ্যারা কোনোও এক গোবিন্দপুর হ'বে আর কি। কে আর সে গাঁয়ের নামটা শুনে উদ্ধার হ'তে গিয়েছে। না-ই বা হ'ল সে গাঁয়ের নাম শোনা... ঐ ছোট্ট গ্রামেই করবাইডের আলো জ্বালিয়ে, খ্যাঁর-খেঁরে মাইকে হিন্দী-ফিল্মের গান বাজিয়ে বিয়েটা হ’ল।
হ্যাঁ, বলা চলে বেশ ধুম-ধাম করেই। আর কিছু না হোক গোটা কয়েক হিন্দী গানের কথা “হারানো সুর”-এর মত এখনও কেন যেন আবছা ভাবে মনে ভাসে।
***
লাল শাড়ী আর দু-হাতে একগাদা কাঁচের চুরি, মেয়েটা এল বৌ হয়ে। এ যে এখনও কিশোরী, নারীত্বের শুধু আভাষ মাত্র প্রকাশিত হয়েছে তার অঙ্গে, কুশুম পরিস্ফুটিত হবার আগেই হল বৃন্তচ্যূত।
ছোঁড়াটার অবশ্য তখন এটা খুব একটা বোধগম্য হয়েছে, তা নয়। নারী-সৌন্দরয্যের আকর্ষণবোধ তখনও ওর ঠিকমত জাগেনি। সিনেমা হলের সম্মুখে অনেক যৌবন ভরা মেয়ে দৃষ্টিগোচর হয়েছে। কখনও বাড়ী তৈরীর কাজের যোগানদারি উচ্ছ্বলিত যৌবনের মেয়ে নজরে এসেছে, দেখেছে দু-একবার দুরন্ত হাওয়া খসিয়ে দিয়েছে এদের কারও বুকের আভরন। হয়ত কোনও অজানা কারনে তার ভালই লেগেছে, পুলকিত হয়েছে তার মন। তবে তেমন একটা অনুভূতি গজায়নি তখনও। কচি, কিশোরী বৌ-এর তনু নিয়ে মাথা ঘামায়নি খুব একটা, তবুও একটা কিছু খোঁচ-খোঁচ করত মনে।
কি নিয়ে আর মাথা ঘামাবে! বাপ-মায়ের খ্যাঁচ-খ্যাঁচানি তো লেগেই আছে, আজকাল এসেছে আবার নূতন আপদ, ঐ বৌ-টার ঘ্যান-ঘ্যানানি।
রোজগারের কিছু একটা ধান্ধা করতে হবে, সিনেমার টিকেট ব্ল্যাকে বিক্রীর বজারটাও চলে না তেমন করে। আজকাল ঘরে ঘরে টি-ভি, সিনেমার আকর্ষন কমে গিয়েছে, তাই ব্ল্যাকের বাজার একদম কাত্। দুটো বিড়ি-সিগারেট ফুঁকবার পয়সাটা মেলে, কিন্তু পেটে গুঁজবার কিছু আর কেনা চলে না এতে। বাপ-মা আর খাওয়াবে না, বুঝতে পারছে। এখন আবার ঘাড়ের উপর এসে জুটেছে মেয়েটা।
... শালা, মেজাজঠা গরম হবে না? হবে বৈ-কি!
একদিন তো ধাঁ করে হাত উঠে গেল বৌএর ওপর। তরপর থেকে চলে এর পুনরাবৃত্তি।
দুর্বলের ওপর বলপ্রয়োগ করাটা যে সহজ। দুর্বলের আবার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ!
বৌ-টাকে মারবে না? আলবত্‍ মারবে ... এতো প্রায় বাপের সম্পত্তি। আরে দূর... বাপের সম্পত্তি হ'তে যাবে কেন ! বাপের সম্পত্তি হ'লে রক্ষা করতে হ'ত ... এটা তো পরের বাড়ীর মেয়ে। ওকে ঘরে এনে তো ছুঁড়িটার বাপ-মায়ের চোদ্দপুরুষ উদ্ধার ক'রেছে... তা একটু-আধটু হাত চরবেই তো, কে ঠেকাবে?
আজও ঘরে ঘরে চলছে বৌ-প্যাঁদানি। হ্যাঁ, হ্যাঁ সব সম্প্রদায়েই চলছে এই বদমায়েশী, এ ক্রিমিনালিটি, নেই এ ক্ষেত্রে উচ্চ-নীচের প্রভেদ। এ ব্যাপারে এরা সবাই নীচে, মানবিকতার সবচাইতে নীচের ধাপেরওএ নীচে। এর নাম পাশবিকতা।
অদ্ভুত ব্যাপার, সেই প্রাচীন কাল থেকে আজ অবধি, বেশীর ভাগ মেয়েরা সব নির্য্যাতন মুখ বুঁজে, প্রায় বিনা প্রতিবাদে সহ্য করছে। কপালটা মন্দ হ’লে সংসারটা শুধু মাত্র বর-বধু নিয়ে নয়, বরের মা-বাপ, বড়-ছোট ভাই-বোন, আরও অনেকে গিঁজ-গিঁজ করে বাড়ীতে। বৌ-ঠ্যাঙ্গানিতে শাশুরী আর ননদেরাও বা পিছিয়ে থাকবে কেন! পরের বাড়ীর মেয়েকে একলা হাতে পেয়ে এরা বীরাঙ্গীনি। চমত্‍কার, শাশুরীও যখন নববধু হ’য়ে এসেছিল, তখন তাকেও হয়ত হজম করতে হয়েছে অনেক রকম নির্য্যাতন ... দৈহিক আর মানসিক। আর আজ? বধুর যাতনা বুঝবার চেষ্টা করা তো দূরের কথা, আগুনে তেল ঢালতে একটুকু পিছিয়ে থাকে না।
***
আগুনে তেল ঢালার কথা? তেল মানে কেরোসিনের দামটা বাজারে খুব চড়ে যাওয়ায় নাকি বৌ-পোরানোটা একটু ক'মেছে। তবুও শোনা যায়... যত সব বাড়ীতে আগুনে পোড়ার কেস্ আসে হাসপাতালে তার বেশীর ভাগ, ধরতে গেলে শতকরা আশীভাগ ভিক্টিম হচ্ছে নাকি মেয়েরা।
যদি প্রশ্ন ওঠে...
“তা, আগুনটা ধরে কিভাবে? আর মেয়েদের সংখ্যা এত বেশী কেন? পুলিশ রিপোর্ট ...”
“পুলিশ রিপোর্ট? টিপিক্যাল, প্রায় সবই এক ধরনের ... ঘরের কাজে, বিশেষতঃ রান্নাঘরে দুঘর্টনা।”
“পুলিশ তদন্ত হয় না?”
“তদন্ত হয় বৈকি ... বাড়ীর অর্থাত্‍ সব সাক্ষী এক মত – দুঘর্টনা। সাধারনতঃ, তদন্তর এখানেই ইতি, আর এগোয় না।”
ব্যাস্ ...! হ্যাঁ, ব্যাস্ ...! সন্দেহ থাকলেও, পুলিশও ঘাঁটায় না ব্যাপারটা খুব বেশী। গনতান্ত্রিক দেশ, নারী-পুরুষের তো সমান অধিকার এখানে ! হ্যাঁ, আইনতঃ, নারী-পুরুষের সমান অধিকার, একথা অস্বীকার করা চলে না। কিন্তু! কিন্তু, দুঃক্ষের বিষয়, একথা আমাদের দেশের সব মানুষগুলোর মগজে ঢোকেনি ঠিকমত।
আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে অস্বীকার করার উপায় নেই... অজাত শিশুর যৌন নির্ধারন করা অতি সহজ আর সাধারন ব্যাপার বটে... কিন্তু অজাত কণ্যার এ্যাবর্শান করাটা নারী-হত্যার ক্রীমিনালিটির সামিল বৈকি। এর ব্যাপকতায় উত্তর ভারতের কোনও কোনও অঞ্চলে বিবাহ যোগ্য মেয়ের সংখ্যা এতটা হ্রাস হয়েছে যে বহু ক্ষেত্রে পরিবার গঠন অসম্ভব হ'য়ে দাঁড়িয়েছে। হ্যাঁ... একেই বলে বুমেরাং-টা আসছে ফিরে।
থাক তবে এ কথা।
ওই চা-ওয়ালার প্রসঙ্গে আসা যাক আবার ... ওর আগেকার সঙ্গীরাও সব ভেগে পরেছে একে একে।
বাড়ীর কাছেই, দুরাস্তা পেরোলেই চোখে পরে, বড় রাস্তার কর্ণারে, পান-সিগারেটের দোকান আর তার পাশে চা-রেস্টুরেন্ট। বেশ চলছে আজকাল, লোকের আনাগগোনা বেড়েছে। গাড়ী, ট্যাক্সির ড্রাইভারগুলো সকাল, দুপুরে গাড়ী থামিয়ে খেয়ে নেয় পেট ভরে।
দেখা যাক না একবার মালিককে জিজ্ঞাসা করে, কাজের লোক লাগলেও লাগতে পারে। কথাটা ঠিকই, রেস্টুরেন্টটা বেশ চলছে, আর লোকেরও দরকার। সময় মতই জিজ্ঞাসা করেছিল মালিককে, কাজের সুরাহা হ’ল। খাবার দেওয়া আর কখনও বতর্ন পরিষ্কার করার কাজ। মন্দ নয়, আঝে-মাঝে দুই এক পয়সা বকশিশও মেলে।
বৌ-এর ঘর-দোর পরিষ্কার করার কাজ জুটলো এক ড্রাইভারের মালিক সাহেবের বাড়ীতে। গাঁয়ের মেয়ে, সহরের হাল-চাল সব-ই ছিল তার সম্পূণর্ভাবে অজানা। প্রথমদিকে ভয় লাগত সব কিছুতে, এখন সয়ে গিয়েছে।
পাশের বস্তিতে একটা ঘর মিলে গেল দৈবাত্‍। একটা ঘর তার সংলগ্ন ছাউনি দেওয়া উঠান, বারিষকালেও খাবার পাকানো চলে।
দিন, মাস আর বত্‍সর অতহিবাহিত হ’য়েছে কতগুলি। সেদিনের সেই কিশোরী দেহেতে ভরা যৌবনের ঢেউ। ভাল করে বৌ-কে দেখবার মত অবকাশ ছিল না আর তার প্রয়াসও করেনি। কাজ সমাপনে দিনশেষে যখন ঘরে ফেরে কালি-ঝুল ধরা কেরোসিনের লন্ঠনের আলোয় ডাল আর চাপাটি-দুটো দেকতে পায় এই-ই যথেষ্ট। লন্ঠনের ফিতেটা কাটেনি কেউ, ধোঁয়ায় আর কেরোসিনের গন্ধে ভ্যাপসা হ’য়ে গিয়েছে ঘর। বৌ-এর গতর দেখবার সাধ হয় না ওর, কেরোসিনের দামও উঠছে ওপর দিকে।
বাবু তার পরিবার নিয়ে দিন-দুই-এক জন্যে শহরের বাইরে কোথাও গিয়েছে, বৌ-এর তাই দু-দিনের ছুটি। একবার সিনেমায় গেলে মন্দ হ’ত না। মালিককে অনেককিছু বলে-কয়ে সাঁজের আগেই ঘরে এল।
বিকেলবেলা, সূর্যটা হেলে পড়েছে, কিন্তু গরম খুববেশী কমেনি। বৌ সবেমাত্র স্নান সেরে ঘরে এসে, মেঝের টুল-এর ওপর বসেছে চিরুনী হাতে, ছোট্ট আয়নাটা সামনে রেখে। আর কোথা থেকে একঝলক আলো চুপি চুপি ঢুকে পরেছে ভাঙ্গা জানালার ফাঁক দিয়ে। সিক্ত, কৃষ্ণবর্ণ চুলেরগুচ্ছ এলোমেলো ভাবে পিঠে ছড়ানো, সদ্য স্নানসিক্ত শারী আরও খানিকটা ভিজে জড়িয়ে ধরেছে নবযৌবনকে মধুর আলীঙ্গনে। খেটে-খাওয়া অভাবগ্রস্থ, অনাদরে বিকশিত নারী, রুক্ষ বনাণীতে প্রস্ফুটিত এক অনামী কুশুম; মেদবিহীন সুগঠিত সে তনু, যেন শিল্পীর বহু যত্নের সৃষ্টি। প্রয়োজন হয়নি তার বডি-বিল্ডিং আর ফিটনেসের ব্যায়ামাগার, বিউটি পার্লার দেখেনি সে কখনও ভেতর থেকে।
নূতন দৃষ্টিতে দেখল বৌকে, এতদিন তো দেখেছে, এ সৌন্দর্য্য দেখবার আর উপলব্ধি করার অন্তর ছিল অবরুদ্ধ। মৃদুভাবে ডাকল’-
“এই শোন্”
“হ্যাঁ, বল"
আশ্চর্য্য, কোনও মুখ ঝামটা নয়, মোলায়েম আবেগভরা কন্ঠ, অবিভুত করে দিল ওকে।
“না, কিছু না, এমনি-ই ডাকলাম তোকে”।
ধীর পায়ে কাছে এসে, অতি সন্তপর্নে তুলে ধরলো বৌকে, মধুর প্রেমালিঙ্গনে স্নিগ্ধ হ’ল দুজনার ব্যাকুল হৃদয়।
***
শারীর আঁচল খসে গিয়েছে, তা আগলাবার ত্বরা নেই। ভালবাসার সোহাগপূর্ণ স্পর্শ প্রেমের প্রথম ছোঁয়াসম উদ্বেল, আকুল করে তুলল সবর্শরীর। চঞ্চল হৃদয়স্পন্দন-অনুভূতি প্রবাহিত হল ত্বকে লোমকুপ থেকে লোমকুপে।
ধিরে, মৃদুস্বরে বললো বৌ-কে,-
“তুই তো ভারী সুন্দর ...”
“কত দিন, কতবার তো দেখেছ আমাকে, কিন্তু আগে তো কখনও ব’ল নি ...”
“দেখবার এ চোখ ছিল কোথায় ...!”
অলক্ষে সিক্ত হ’ল চোখের কোন ... এক বিন্দু অশ্রুকণা, ভালবাসা উদ্বেলিত নারীহৃদয়; প্রেমের নিঃশব্দ আনন্দধারা।
সিনেমায় যাওয়ার কথা ভুলে গেল দুজনেই।
কতগুলো দিন, বছর কেটে গিয়েছে মাঝখানে। সে রেস্টুরেন্টটাও আর নেই, বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেকদিন হল। কিছুদিন চেষ্টা করেছিল সব্জী বিক্রী করার। সাত-সকালে পাইকারী বাজার থেকে আনাজ খরিদ করে খুচরো বাজার আর রাস্তায় রাস্তায় বসেছে কতদিন। ঠিক সুবিধে করে উঠতে পারে নি; দু-পয়সার মাল নিয়ে বাবুরা করে দু-ঘন্টা দরাদরি।
এখন ফেরি করে ট্রেনে-ট্রেনে চা-কফি।
জীবনটা তো সিনেমা-জগত্‍ নয়, যে হটাত্‍ বরাত খুলে যাবে ...!
তবুও এই চা-কফির দৌলতে সংসারটা চলে যাচ্ছে কোনও ভাবে। অবস্থাটা কিছুটা ভালো হয়েছে, এটা বলতেই হবে। পাশের বাড়ী থেকে আনা বিজলী-তারে একটা বাল্ব লাগিয়ে হ্যারিকেনের ঝামেলাটা মিটেছে। এজন্যে ওদেরকে মাসে মাসে একটু বেশী পয়সা দিতে হয় অবশ্য, কিন্তু বিজলী আলোর সুবিধে তো পাওয়া যাচ্ছে। বাড়ীওয়ালার মর্জী হলে নিজস্ব বিজলী মিটার পাওয়া যাবে ইলেক্ট্রিক কোম্পানীর... মালিক ব্যাটা এতদিনে রাজী হয়েছে অনুমতি দিতে।
বেচারি বৌ-টা! বাচ্চা হবার পরে বাবুরা আর কাজ দেয়নি। তিন, তিনটে ছেলে মেয়ে, ঐ প্রাইমারী স্কুলের বেশী আর হল না। এলোমেলো ভাবনাগুলো স্তব্ধ করে দিল ওকে, ক্ষনিকের তরে। একটা দীঘর্র্শ্বাশ বেরুলো ... অজান্তে অনিচ্ছাতেই। না, বৌটাকে আর পেটাবে না।
পরের স্টশনটা প্রায় এসে গিযেছে, নেমে উল্টো দিকের ট্রেন পাকরাতে হবে। কেটলিটা হাতে নিয়ে ছুটলো দরজার দিকে।

“কফি ... কফি; চায় গরম ।...”
***
... ক্রমশ

Thursday 3 September 2009

পথে-ঘাটে ১


পথে-ঘাটে

স্ফুলিঙ্গ


কলকাতার ছেলে দিবাকর, সে বহুদিন বহু বৎসর হ'ল ঘরের বাইরে মানে ভারতের বাইরে... জার্মানী প্রবাসী। ইওরোপ থেকে ভারতে আসবার সময় দিবাকর সাধারণতঃ মুম্বাই অথবা দিল্লী নেমে ক'টা দিন এ শহরে কাটিয়ে ট্রেনে কলকাতা আসে। বিভিন্ন রকমের যাত্রীদের সাথে ট্রেনের দীর্ঘযাত্রার সময়টা কেটে যায় ভাল-মন্দের মিশ্রণে, নানা রকম গল্প-গুজবে, তর্ক-বিতর্কে।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে শহরের বহুতল বাড়িগুলিকে পিছনে রেখে এগিয়ে চলে ট্রেনটা শহরতলীর আঁকা-বাঁকা লাইনের ওপর দিয়ে। লাইনের ধারে ছাপরা-বস্তী। মরচেধরা টিন,ছেঁড়া চট, প্লাস্টিকের বস্তা আর বাঁশের চাটাই বা আধ-পচা কাঠের টুকরো দিয়ে তৈরি আস্তানায় কোনমতে মাথাগুঁজে থাকে অগণিত মানুষের দল। গরু, কুকুর, বখরী আর সব পশু-পাখীদের পাশা-পাশি বাঁচবার প্রতিযোগিতা চলছে পুরোদমে। শতছিদ্র মলিন বস্ত্র দ্বারা লজ্জা নিবারণের প্রয়াস বৌ-মেয়েদের।

আঙ্গিনায়, ছোট্টো মাঠে, পথের বাঁকে অথবা পানা ভরা ডোবার ঘাটের ধারে খেলছে কতগুলো বাচ্চা, কারও পড়নে ছেঁড়া কালো হয়ে যাওয়া হাফ-প্যান্ট, হয়ত কোনও কালে এর কিছু একটা রং ছিল, ... আর ঐ মেয়েটার গায়ে একটা কিছু, যার নাম ছিল কখনও ... ফ্রক। আর অন্য ছোঁড়া-ছুঁড়ীদের তো তাও যোটেনি, ন্যাংটো হয়ে ছোটা-ছুটি করছে; আর কতগুলো চ্যাঁচাচ্ছে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে।
সব শহরের আশে-পাশে এই একই দৃশ্য ... না, কেবল মাত্র শহরতলীতে নয়, শহরের মাঝে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে অগণিত ভাগ্যহত মানুষের মাথা গোঁজবার ঠাঁই - এই সব বস্তী, ... পরিচয় বিহীন মানব সন্তানের শুধু অস্তিত্ব।

সন্ধ্যায় নেই সেথা ঘরে ঘরে নিওন আলোর ঝলকানি, হ্যারিকেনের মিট-মিট করা আলো আর এদিক ওদিক একটা-দুটো ভাগ্যবান্‌ বাসিন্দার বিজলী-বাল্ব চেষ্টা করে চলেছে আঁধারঘন রাতটি একটু আলোকিত করে তুলতে।

ট্রেন-টা চলেছে মন্থর গতিতে ... প্রাতঃকর্ম সমাপন উদ্দেশ্যে, শরমের মাথা খেয়ে, লাইনের ধারে লাইন দিয়ে বসেছে অনেকে লোটা হাতে, কারও হাতে বিসলেরির পুরোনো প্লাস্টিক বোতল ... না, শুধু বিসলেরি কেন হ’তে যাবে, অন্য কোনও মিনারাল জলের বোতলও হ’তে পারে।
আজকাল তো ভুরি-ভুরি জলের কোম্পানী গজিয়েছে ব্যাঙ-এর ছাতার মত সরাটা দেশ জুড়ে, তারই কোনও একটা হবে। দূর ছাই, কে আর তাই নিয়ে মাথা ঘামাতে যাচ্ছে!
কেনই বা মিনারাল জলের কোম্পানী গজাবে না? মিউনিসিপ্যালিটির জলের তো নেই কোনও ভরসা, সরবরাহ নেই পর্যাপ্ত পরিমানে আর যা-ও বা মেলে তা নাকি ভুর-ভুর করছে জীবাণুতে, খেয়েছ ত’ মরেছ। যাদের এই বোতলের জল কিনবার মত দু-টো অতিরিক্ত পয়সা আর প্রাণের মায়া আছে, তারাই কেনে এ জল।
এত-ই কি দরিদ্র এ দেশটা, যে ঠিকমত জলটা পর্য্যন্ত মেলা ভার! এ প্রশ্ন সবাইকার মনে মাঝে-সাঝে জাগে বটে ... কিন্তু নিত্য দিনের নিত্য নূতন ঝামেলার মাঝখানে কোথায় যেন তলিয়ে যায় এ কথা। অবশ্য বিস্মৃতির কোলে হারিয়ে যায় না দৈনন্দিন সমস্যার কথাগুলো... পুঞ্জীভূত হচ্ছে যব সব ক্ষোভ মনের কোনে, কখনও বিষাদের রূপে, কখনও বা তিক্ততায় ভরা।

***
ভারতে ট্রেনে বিশেষতঃ দূরপাল্লার গাড়ীতে নিঃসঙ্গতার বালাই একদমই থাকেনা বললে খুব একটা ভুল হ'বে না ... বলা চলে। এ কথা দিবাকরের অজানা ছিল না, দিবাকর নিজেও কখনও মুখচোরা ছিল না, তাই সহযাত্রীদের সাথে পরিচিতি হ'তে খুব একটা বেশী সময়ের দরকার হ’য় নি। দিবাকর জার্মানীতে থাকে, ছুটিতে সপরিবারে এসেছে ভারতে, আর ওর বৌ জার্মান মেয়ে... গাড়ীর চাকাগুলো ঘুরতে শুরু করতে না করতেই এ কথা জানতে বাকি রইল না, কারও। ট্রেনে সহযাত্রীদের আসরটা জমতে শুরু করেছে, ছোট-খাট কথা-বার্তা একটু আলোচনা... এ যাকে পশ্চিমী ভাষায় "স্মল টক্" বলা হ'য়। পাশের বার্থগুলিতে... এক ভদ্রলোক দিব্বি তার দৈনিক কাগজটা নিয়ে ব্যাস্ত, আর অন্য যাত্রীদের কেউ চলচ্চিত্র অথবা অন্য কোনও সপ্তাহিক কাগজে মগ্ন, কেউ বা খোলা জানালার পাশে বসে শুধু বাইরের দিকে তাকিয়ে সময়টা কাটাবার চেষ্টা করছে। বেলা বাড়ছে আর তার সাথে বাড়ছে ধীরে ধীরে গরমটাও।

ঐ ভদ্রলোক খবরের কাগজটা ভাঁজ করতে করতে হু-ট করে প্রশ্ন করে বসলো, -
“আরে মশাই, ট্যাক্স-ফ্যাক্স-এর টাকাগুলো যাচ্ছে কোথায়?”
এর আর কি উত্তর আছে! ... এক যাত্রী আমতা আমতা ক’রে কিছু একটা বলবার চেষ্টা করাতেই ফুঁশ করে অন্য একজন বলে উঠলো -
“আরে বলুন না স্যার, বলেই ফেলুন না যা আপনি ভাবছেন ...
জনগনের পকেট খালি হ'চ্ছে আর... টাকার বড় ভাগটা যে রাজনীতির হোমরা-চোমরা বাবুদের পেটে গিয়ে ওইখানেই হজম হচ্ছে আর তার যেটুকু উচ্ছিষ্ট থাকছে সেটারও ভাগ-বাঁটোয়ারা হচ্ছে অফিসের বাবুদের থলিয়াতে।”
"আরে মশাই সত্যি কথা বলতে কি আপনার জিভটা নড়তে চাইছে না! বলেই ফেলুন না আপনি যা ভাবছেন, আহা কেউ জানে না বুঝি!..." একটু উত্তেজিত আর বেশ নাটকীয় স্বর ছিল ঐ ভদ্রলোকের ভাব-ভঙ্গীতে। এখন তার নজরে এল দিবাকর।
আপনি মশাই দেশের বাইরে থাকেন, তাই বলে কিচ্ছু খবর রাখেন না না-কি! কলিকাল চলছে মশাই ... কলিকাল চলছে”।
ভদ্রলোকের মাথাটা একটু গরম হ’য়ে গিয়েছে বলে মনে হল ...
একটু থেমে, দুই পাশের পকেট হাতরিয়ে একটা রুমাল দিয়ে প্রথমে মুখের বাঁ-দিকটাতে দুবার ঘষে তারপর ডানদিকটা ধীরে ধীরে মুছে নিয়ে বলতে শুরু করলেন,
“দেখবেন, ... এ একবার তোলপাড় হয়ে যাবে বলছি, ... দেখবেন, সব বাবুদের বাবুগিরি একটা দিন খতম হ’য়ে যাবে, ওলোট-পালোট হ’য়ে যাবে মশাই ... সব কিছু”
কথা বলার ঢং-টা মন্দ নয় ভদ্রলোকের, শুরু হয় নীচু গলায় তারপর উঠতে থাকে তার কণ্ঠস্বর। জল আর ঘাঁটাবার সাহস হল না দিবাকরের।
কলিকাল-টালের কথা না হয় না-ই হল, আসল কথাটা তো ভুল নয়, করাপশন্ ... ঘুষ, নৈতিক অবনতি গোটা দেশ জুড়ে। এসব তো নূতন কথা নয়, এ চলছে ... আর চলছে ...
সাধারণ লোকেরা একথা জানে না - এটা সম্ভবতঃ পুরোপুরি ভাবেই ভুল ধারনা।
মনে হল বারুদের স্তুপ জমে রয়েছে, কখনও একটা ফুলকি পড়লেই হল ... একটা স্ফুলিঙ্গ, তারপর আকাশ বিদীর্ণ বিস্ফোরণ।


***

... ক্রমশ