দেশ বিদেশ, পথে-ঘাটে, লেখনী, প্রবাসীর চিঠি

Tuesday 2 March 2010

পথে-ঘাটে ৭ ... ঝরা পাতা

পথে-ঘাটে
ঝরা পাতা

ক্ষণিকের নীরবতা। নাসিম মাসী কারও দিকে না তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন পিছনে রেখে আসা দিনের কথা ...

আমার ছোট বেলার দিনগুলি কেটেছে সহজ, স্বাচ্ছন্দ্যে। বিলাসিতা আর আর্থিক বিশেষ সচ্ছলতা না থাকলেও বাবা-মাএর আদর, ভালবাসার অভাব ছিল না কখনও। আর ছিল না কোনও বাধা-নিষেধ, পাড়ার ছেলে-মেয়েদের সাথে মিশতে, খেলতে আড্ডা মারতে ছিল না বাপ-মাএর কোনও বকা-বকি আর চোখ রাঙ্গানো শাসন।

মাঝে-সাঝে অবশ্য মাকে বলতে শুনেছি,
- মেয়েটাকে আদর দিয়ে বড় বখাটে করে তুলেছ, বাড়ির কাজের বালাই নেই কোনও ... সব সময় পাড়া ঠেঙ্গানি। বাবা তখনই বলত...
- আরে ছাড় তো তোমার ওই বাড়ির কাজ, যখন দরকার হবে তখন ও আপনি-ই শিখে নেবে। পাড়ার ছেলে-মেয়েদের সাথে একটু খেলছে - তাতে হ'লটা কি! ওর ইস্কুলের প্রগ্রেস রিপোর্টগুলো তো দেখেছ, আর কি চাই?

ব্যাস, মার মুখ হ'ত বন্ধ। আর আমি খুশিতে উঠতাম নেচে, ধেই-ধেই করে এ পাড়া ও পাড়া ঘুরতাম সাঙ্গ-পাঙ্গদের সাথে। আর আমার কাছে বাবা ছিল তখন যে কোনও হিরো থেকে বড়।

সে সময়, ভারতের স্বাধীনতার পর মাত্র কতগুলি বছর কেটেছে, ... কলকাতার আশে-পাশে নূতন শহরতলি গড়ে উঠছে। বিশেষ করে আমাদের এই দক্ষিণ কলকাতার শহরতলিতে চারদিকে নিত্য নূতন কলোনির সৃষ্টি হচ্ছে তখন ... ভারত ভাঙ্গার পর পূর্ব বঙ্গের ভিটে থেকে উৎখাত হওয়া অগণিত পরিবার কোনমতে মাথা গোঁজবার ঠাঁই করে নিয়েছে এই সব এলাকায়। বাঁশের চাটাই ঘেরা টালির অথবা টিনের চালা ঘর।
দেখেছি, যাদের পক্ষে সেটা সম্ভব হয় নি, তারা থাকত শিয়ালদা স্টেশনের চারদিকে, হাওড়া আর অন্য সব ব্যস্ত সড়কের ধারে, রেল লাইনের আশে-পাশে, বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার বাস্তুহীন কুকুর-বিড়ালের সাথে ওদেরই মতন একটুকু জমি ভাগাভাগি করে। কখনও পেটের দায়ে ওই কুকুর-বিড়ালের শরিক হয়ে সন্ধান করেছে খাদ্যর, ডাস্টবিন থেকে ডাস্টবিনে।

বাবার কাছে শুনেছি, স্বাধীনতার মূল্য দিতে হয়েছে ভারত ভেঙ্গে, বাংলা আর পাঞ্জাব ভেঙ্গে - দেশটাকে খণ্ড-বিখণ্ড করে। হিন্দু-মুসলমান ভাই-ভাইয়ের রক্তাক্ত লড়াই, - এ বর্বরতার বলিদান হয়েছে লক্ষ লক্ষ জীবন। ছারখার হয়েছে শান্তি আর সম্প্রীতি । এই বর্বরতার দুর্যোগের সময় পাড়ার হিন্দু বন্ধুরা আশ্রয় দিয়েছে আমার মুসলিম বাবা-মাকে, তাদের জীবন রক্ষা করেছে।

শুনেছি, ভাঙ্গা দেশটার অপর অংশেও ছিল এই একই দুর্ভাগ্যের চিত্র।
খুব খারাপ লাগত এ সব শুনে, কিন্তু কেন যে এ সব ঘটেছে তার উত্তর ছিল না সে সময়, আমার মত ছোট মেয়ের মগজে।
আজও মনে পরে আমার ছোট বেলার সেই দিনগুলি ...

সে সময় এ শহরতলি আর তার চতুর্দিকে সব এলাকা ছিল না এতটা ঘিঞ্জি, আম, কাঁঠাল আর অন্য সব ফলের গাছের অভাব ছিল না কোথাও। স্কুলের ছুটি হতে না হতেই ছুটতাম আমরা এ পাড়া-ওপাড়া। কখনও জাম, জামরুল - কখনও বা বহু কাঁটা হজম করেও কুল চুরি করা। টক কাঁচা আমের প্রলোভন কোনও মাসি, বৌ-দি বা দিদির বকুনি আর ধমকানি বন্ধ করতে পারত না তখন। কোথাও খোলা মাঠে পা ছড়িয়ে অথবা গাছের ডালে বসে পা দুলিয়ে মনের সুখে নুন দিয়ে খেয়েছি আমরা কাঁচা আম ... যতক্ষণ না দাঁতগুলি শির শির করে উঠত।

বাড়ির কাছেই ছিল বড় এক শিউলি গাছ, সকালে শিশির ভেজা ঘাসের ওপর ছড়িয়ে থাকা ফুল সংগ্রহ করতাম বন্ধুদের সাথে - আঁচল ভরে। শিউলি ফুলের সে সৌরভ এনে দিত প্রতিদিন গোটা বাড়িতে স্নিগ্ধ মধুরতা।

এদিক ওদিক বসত সে কালে নানা রকম মেলা, - মেলায় পাঁপর খাওয়ার লোভ ছিল সব ছেলে মেয়েদের... আর আমারও বইকি।

বাস-টাস তো ছিল না এ সব এলাকায়, পায়ে হেঁটেই যেতাম আমরা কাছে, দূরে যত সব পাড়ায়। রিক্সার পয়সা আর মিলবে কোথা থেকে! সে সময়, চড়ক মেলা বসত বেশ দূরে, পশ্চিম পুটিয়ারীতে, - কুঁদঘাটের খাল পেরিয়ে যেতে হ'ত। সে সময় বলা হ'ত - 'আদি গঙ্গা' ... হ্যাঁ, নৌকাও চলত সে সময় ওখানে, দূর গ্রাম থেকে আসত শাক-সব্জী আর হরেক রকম মালপত্র ওই জলপথে। ছিল না কোনও ব্রীজ বা সাঁকো - খেয়া পার হ'তে হত তখন ঐ ঘাটে।
ওঃ, সেই দিনগুলি মন্দ ছিল না, বেশ রোমাঙ্চকর ছিল ওদিক আসা-যাওয়া।

বিশেষ কোনও বাধা নিষেধ ছিল না বাবা-মার - তবে সন্ধ্যার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হ'ত। ছিল না ধর্মের কোন গণ্ডি, - সব উৎসবে, সার্বজনীন পূজায় যেতাম সবাই দল বেঁধে পাড়া থেকে পাড়ায়, মণ্ডপ থেকে মণ্ডপে। দুই ধর্ম... মনে হ'ত একই ঘরের দুটো জানালা। ভালই লাগত - দুই ধর্মের উতসবেই মিলত নূতন পোষাক। সেবার ক্লাস নাইনে নূতন বছর সবে শুরু। সন্ধ্যাদি, আমাদের ইতিহাস দিদিমনি আমার ওপর চাপিয়ে দিলেন স্কুলের সরস্বতী পূজার চাঁদা তোলা আর মণ্ডপ সাজানোর দায়িত্ব। আমি আপত্তি করে বললাম..
- আমাদের বাড়িতে কোনও পূজা হয় না, আমি কি করে এই কাজের ভার নিতে পারি!
- আরে নাসিম, আমাদের বাড়িতেও কোনও ধরনের ধার্মিক অনুষ্ঠান হয় না,- আমাদের পুরো পরিবার কমিউনিস্ট ‌এবং নাস্তিক। তবুও বড়দিদিমনি আমার ওপর পূজার পুরো ব্যবস্থাপন দায়িত্ব চাপিয়েছেন। যদি আমরা ধরে নিই যে কোনও ঈশ্বর আছে, তা হলে তার কাছে সব মানুষ সমান, নেই কোন ভেদাভেদ। এই ধর্ম নিয়ে আমরা মানুষেরাই করছি মারামারি, কাটাকাটি - অর্থহীন ভাবে। আচ্ছা, জোর করছি না, তুমি তোমার বাবা-মাকে জিজ্ঞাসা করে দেখবে, আশা করছি তাঁদের কোনও আপত্তি থাকবে না। - বললেন সন্ধ্যাদি।
বাবা-মার বিন্দুমাত্র আপত্তি ছিল না এতে, তাই কোন অজুহাত আর রইল না, অগত্যা কাজের ভার নিতে হ'ল।
এতদিন কত বাচ্চা-পনা করেছি - এখন পূজা অর্গানাইজেশন কমিটি-তে দায়িত্বপূর্ণ কাজ শেখা শুরু। তবে এই কাজের অজুহাতে ক্লাস ফাঁকি দেবার সুযোগ ও পেয়েছি অনেক। আর বাড়ি ফিরতে দেরি হলেও ছিল না কোন বকুনি। পূজা অনুষ্ঠানের আগে সব মেয়েদের সাথে সারা রাত জেগে মণ্ডপ সাজানো পূজার আয়োজন করা... ছিল এক অভূতপূর্ব, সুন্দর অভিজ্ঞতা।...
পূজার দিনটা গত হ'ল, গত হ'ল সে বছর, আর দেখলাম সরস্বতী ক্ষুণ্ণ হন নি আমার ওপর। এর পর, একদিন শেষ হ'ল স্কুল যাওয়া-আসার দিনগুলি। ঝরা পাতার মত খসে পড়ল দিনগুলি এক এক করে ...

শেষ হ'ল ছোট-বেলা।

***
ক্রমশ

Thursday 17 December 2009

পথে-ঘাটে ৬ ... স্কুটার

পথে-ঘাটে


স্কুটার

সে দিন শনিবার্। আলসেমিটা কোনও মতে কাটিয়ে সকালের চা, মুড়ি আর মুখরোচক চানাচুর দিয়ে প্রাতরাশ।

দিবাকর আর চিত্ত ঘুরছিল সাউদার্ন এভিনিউ-এ। চিত্ত এক প্রতিষ্ঠানের ট্রান্সপোর্ট ইঞ্জিনিয়ার ... দিবাকরের সাথে পরিচয় সেই ম্যাক্স-মূলার ভবনের জার্মান-ভাষা ক্লাস থেকে ... সেদিনের পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। কখনও সপ্তাহান্তে অথবা কোনও ছুটির দিনে সময় পেলে ও দিবাকরকে স্কুটার চালানো শেখায়। সেদিন টালিগঞ্জ লেকের পাশ দিয়ে স্কুটার চালাচ্ছিল দিবাকর। এই রাস্তায় এমনিতেই খুব একটা ভীড় থাকে না, আর এ সময়টায় প্রায় ফাঁকাই বলা চলে। ড্রাইভিং প্র্যাক্টিস করবার পক্ষে উপযুক্ত রাস্তা বটে।

আরে... দীপদা না! ... স্কুটার নিয়ে হুস করে বেরিয়ে গেল। তাইতো দীপদা-ই হবে, জয়া কলেজের এক বান্ধবীর সাথে শনিবার দুপুরের নিরিবিলি সাউদার্ন এভনিউ-এ যেতে যেতে হটাত নজরে পরল দিবাকর-কে। জয়ার ডাক ওর কানে আর পৌঁছোয় নি। ভালই হয়েছে, ওঃ 'দীপদা কিং অব দ্য রোড্'... ছোট্ট মেয়ের মত নেচে উঠল জয়ার মন দুষ্টুমিতে। আসুক না আজ দীপদা... বেশ ভাল করে রাগানো যাবে।

বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই জয়া হট্টগোল শুরু করে দিল...
- মা, মা শুনছ ... কোথায় গেলে তুমি!...
চেঁচামেচির ঠেলায় নাসিম মাসী আর আমীর দুজনেই কাজ-কর্ম সব স্থগিত রেখে এসে পড়ল...
- আরে, ব্যাপারটা কি? এত সব চেঁচামেচি... তা হ'লটা কী?
- দীপদাকে দেখলাম আজ - রাস্তায়, ডাকলাম কিন্তু একবার তাকিয়েও দেখল না।
- দূর, কাকে না কাকে দেখেছিস ... অমনি দীপদা হয়ে গেল! দিবাকর তোকে চিনবে না, এটা হ'তেই পারে না। ... বলল আমীর।

নাসিম মাসী একটু হেসে ভর্তসনা স্বরে বললেন
- পাগল মেয়ে, দীপ ও রকম ছেলে হতেই পারে না... রাস্তায় কাকে দেখেছিস! নতুন চশমার দরকার বোধ হয়!
- হ্যাঁ, আমার চোখ খারাপ, মাথাটাও হয়ত খারাপ... আরে, আমি স্বচক্ষে দেখলাম দীপদা সাদার্ন এভনিউ-এ স্কুটার চালিয়ে যাচ্ছে। পিছনের সীট-এও ছিল একজন, দীপদার কোনও বন্ধু-টন্ধু হবে। দেখতে পেয়ে ডাকলাম, কিন্তু ফিরেও দেখল না।
- ওঃ, জয়া... বড় বুদ্ধিমতী বোন আমার। তোর ডাক তো দীপ শুনতেই পায় নি! তা, ফিরে আর দেখবে কাকে?
- হ্যাঁ, ঠিক তাই হবে ... আর সে যাই-ই হ'ক, দীপদাকে একটু রাগাতে হবে।
নাসিম মাসী ধূপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন ...
- জয়া, ঠিক দেখেছিস কি দীপকে স্কুটার চালাতে? ...
- আরে হ্যাঁ মা, হ্যাঁ, দীপদাকে চিনতে আমার ভুল হবে নাকি ... তোমাদের হয়েছে-টা কী?
- না, কিচ্ছু না।

মা-র কণ্ঠস্বর হটাত কেন যেন অপরিচিত, বিচলিত লাগল জয়া আর আমীর এর কাছে। একটু থমকে থেকে জয়া এগুলো রান্না ঘরের দিকে।

***

ড্রাইভিং প্র্যাক্টিস তারপর 'মৌচাক'-এ মিষ্টি খাওয়া আর কিছুটা সময় আড্ডা। কেটে গেল গোটা দুপুর - টের পাওয়ার আগেই। যাদবপুর বাড়ির পথেই পরে, চিত্ত দিবাকরকে বাস-স্ট্যান্ড অবধি পৌঁছে দিল।

দরজাটা জয়াই খুলল।
- এস দীপদা, বস এক সেকেন্ড - চা আনছি।

দীপের বহু দিনের চেনা ঘর, নিজেদের বাড়ির মতই। কোনও ফর্মালিটির বালাই নেই ... সহজ, আন্তরিক। শনিবার অপরাহ্ণ, রোদটাও কমেছে আর সেই সাথে গরমটাও। ছেলে মেয়েরা বেরুচ্ছে ধীরে ধীরে। খোলা জানালায় ভেসে আসছে মৃদু কোলাহল, আর তারই সাথে এদিক ওদিক থেকে পড়শীদের রেডিওর নানা গানের মিশ্রণ। আমীর নিমগ্ন ছিল একটা বই নিয়ে। বইটা নামিয়ে রেখে বসল দিবাকরের পাশে।

- তারপর, কেমন আছ দীপ?
- আরে, বেশ ভাল। আজ একটু ড্রাইভিং প্র্যাক্টিস করলাম, মোটামুটি ভালই হচ্ছে। মাসীমা কোথায়?
- মা রান্না ঘরে, সম্ভবতঃ পেঁয়াজী টেয়াজী কিছু করছে জয়ার সাথে।

গরম চা আর তার সাথে নাসিম মাসীর তাজা পেঁয়াজী নিয়ে জয়া আর মাসী দুজনেই হাজির। কাপগুলোতে চা ঢেলে সবাইকে দিতে দিতে জয়া বলল...
- আচ্ছা, দীপদা তোমাকে আজ দেখেছি বলে মনে হচ্ছে। তুমি কি আজ দুপুরে স্কুটার চালাচ্ছিলে ... সাদার্ন এভিনিউ-এ?
- হ্যাঁ, তাই তো, কিন্তু তুমি কোথায় ছিলে?
- আরে, আমি কলেজের এক বান্ধবীর সাথে ওই রাস্তায় ঘুরেছিলাম... তোমাকে ডাকলাম, কিন্তু তুমি দেখলেই না।
- আচ্ছা পাগল তো তুমি... শুনতে না পেলে, সাড়া দিই কী ভাবে, আর দেখবই বা কী করে? দেখছেন মাসীমা কেমন সব পাগলের মত কথা বলছে!
... হাসতে হাসতে বলল দিবাকর।

নাসিম মাসী কোনোও সাড়াশব্দ নেই, কথার উত্তর দেওয়ার কোনও প্রচেষ্টা না করে, অকারণ চা-কাপটা নাড়াচাড়া করছেন, কেমন যেন উদাস, অনুপস্থিত। কোনও কারণে এক বিষাদ ভরা ছায়া আবৃত করছে তাঁর মুখমণ্ডল ... এটা কারও নজর এড়ালো না। একটু অস্বস্তিকর পরিস্থিতি- অনুভব করল সবাই। ব্যাপারটা কী বুঝতে না পেরে চুপ রইল দিবাকর। জয়া আর আমীর - দুজন প্রায় এক সাথে জিজ্ঞাসা করল,
- কী হয়েছে, মা?
- আরে না, কিছু না তো!
- না, তা হবে না ... এভাবে কথাটা এড়ানো চলবে না। বল না মা, কী ব্যাপার, আজ দুপুর থেকেই তুমি কোন্‌ও কারণে মুষড়ে আছ। তুমি না বললে আমাদেরও শান্তি নেই।

একটু নীরব থেকে নাসিম মাসী ম্লান হেসে বললেন...
- আজ দুপুর থেকেই মনটা খারাপ হয়ে উঠেছে। জয়া যখন হৈচৈ করে খবর দিল দীপের স্কুটার চালানোর কথা, তখন থেকে তোলপাড় হচ্ছে হৃদয়।
মাসীর কথা শুনে দিবাকর ত' হত-বাক, ব্যাপারটা ওর বোধগম্য হ'ল না মোটেই। শুধু দিবাকর নয় সবাই অপ্রস্তুত। ক্ষণিকের সে নিস্তব্ধতা, জড়তা কাটিয়ে মৃদুস্বরে দিবাকর চাইল মাসীর দিকে, বলল-
- হ্যাঁ মাসীমা, আজ স্কুটার ড্রাইভিং প্র্যাক্টিস করছিলাম,- তা ওতে দোষটা কী হ'য়েছে! ...
- না, না দীপ... তোমার দোষ কোথায়! তুমি ড্রাইভিং শিখছ এক তিল-ও দোষ নেই এতে। তবে তোমার স্কুটার চালানোর কথা শুনতেই খচ্‌ করে উঠল মনটা।
কোন কিছু বুঝতে না পেরে, ফ্যাল্-ফ্যাল্‌ করে চাইল সবাই নাসিম মাসীর দিকে।
- এই স্কুটারের বলিদান হয়েছে আমার সব চাইতে প্রিয় মানুষের ... আমার সকল প্রাণের ভালবাসা সুব্রত-কে ছিনিয়ে নিয়েছে ঐ স্কুটার। তাই স্কুটার কথাটা শুনলে উথাল-পাথাল হয়ে ওঠে আমার মন। দীপ, এই কটা দিন হ'ল মাত্র, কোথা থেকে তুমি এলে এখানে, ঠাঁই করে নিলে আমাদের মাঝে ... এখন, এ পরিবারে আমাদের-ই একজন। এ কারণে মনটা কোনও এক আশঙ্কায় খারাপ হয়ে গেল।

মাসীর কথা গুলি স্পর্শ করল সবাইকে। আমীর বলল ...
- বাবার এ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল সেটা আমরা জানি, কিন্তু সব কিছু বিস্তৃত ভাবে জানা নেই আমাদের। আর নূতন ক'রে তোমার আঘাত লাগবে এই ভয়ে, এ প্রসঙ্গে তোমাকে জিজ্ঞাসা করি নি আমরা - কোনও দিন।
- শুধু ওই স্কুটার এ্যাকসিডেন্ট নয় ... আরও অনেক কথা, আমাদের কথা, সুব্রত আর আমার কথা, যা অনেকদিন, অনেক বার বলি বলি করেও আর বলা হয় নি।
নাসিম মাসীর বিচলিত কণ্ঠ -

- যা কিছু এতদিন ধরে বয়ে বেড়াচ্ছি, আজ তাহলে বলছি তোমাদের ...

***
ক্রমশ

পথে-ঘাটে ৫ ... মর্ণিং-শো

পথে-ঘাটে



মর্ণিং-শো
টেবিলে চা এর সরঞ্জাম করা ছিল ... দিবাকর আসতেই গরম চা আর সেই সাথে হালুয়া। হালুয়াটা নাসিম মাসীর করা ... ওটা করার একটা স্পেশাল ফর্মূলা আছে নাসিম মাসীর। একটা চামচ মুখে দিয়েই দিবাকর বলল
- নাঃ, এটা খাবার নয়...
নাসিম মাসীসহ সবাই একদম থতমত... জয়া তো ঘাব্‌ড়েই গিয়েছে, বিলকুল ...
- না, মাসীমা এটা খাবার নয়... এটা হচ্ছে অমৃত।
সত্যি-ই দিবাকর জাদু জানে... মুহূর্তে আবহাওয়াটা পাল্টে গেল...
- ওঃ দীপদা, সাত জন্মেও তোমার কোনও শত্রু হবে না।
হাসিতে ভরে গেল ঘর।
- মাসীমা, আমি রবিবার সিনেমার কতগুলি পাস পেয়েছি... যাবেন আমাদের সাথে? পুরোনো বাংলা ছবি...
- দূর পাগল, খেয়ে-দেয়ে আর কিছু কাজ নেই ... সিনেমা যাও।
স্বভাবতঃ-ই সবাই কিছুটা নিরাশ... কিন্তু দিবাকর হাল ছাড়বে না। পুরোনো ভাল ছবি কিন্তু ...
- কী সে ছবি?
- শিল্পী।
- শিল্পী! হ্যাঁ, ছবিটা ভাল ঠিকই ... পাস পেয়েছ, কটা! চারজনের?
- তা, সেটা নষ্ট করে আর লাভ কি! ঠিক আছে... কিন্তু তারপর রান্না-বান্না কিন্তু তোমরা করবে। রাজী তো!
- খুউব রাজী মাসীমা...
- ওরে বাবা! দীপদা ... তুমি করবে রান্না! মানে রবিবার আমাদের গণ-উপবাস।
- দেখা যাবে!
- কেন যে দীপের পিছু লাগিস!
- ঠিক বলেছেন মাসীমা...
- মা, তুমি বড় পক্ষপাতী ... সব সময়-ই দীপের পক্ষে...
চেঁচিয়ে উঠল দুজনে।

***

রবিবারের বাজার। শহরের ঘুম ভাঙ্গেনি এখনও ... এই আধ জাগ্রত, আধ নিদ্রামগ্ন। বাস-ট্রামগুলো সব প্রায় খালিই বলা যায়। দোকান-পাট খোলে নি সব এখনও। দুই এক জন লোক বাজারের থলি হাতে মন্থর গতিতে এদিক ওদিক হাঁটছে... লেক মার্কেট অথবা যগু বাজারের দিকে, আজ আর সে দ্রুততা নেই। সাতসকালে বাস-ট্রাম আর গাড়ির কানের-পর্দা ফাটানো গর্জন প্রায় নেই, নেই মহানগরীর পথিকের চঞ্চলতা। তাই, শহরের রাস্তা যাদের বেড-রুম, রবিবার-এর কল্যাণে তারাও একটু বেশী ঘুমোবার বিলাসিতার সুযোগ থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বঞ্চিত হয় নি। একটু জাগো জাগো ভাব... কোথাও ট্যাঁ - ট্যাঁ করছে রাস্তার ধুলি মাখা কটা বাচ্চা, কোথাও বা কোন বাচ্চা আপ্রাণ চেষ্টা করছে তার ক্ষুধা বিবৃত করতে - নিরুপায় মায়ের শুষ্ক স্তনে। এদিক ওদিক আঁচ দেওয়া হচ্ছে কয়লার উনানে। কোথাও রাস্তার ধারে জলের ট্যাপ বা টিউব-কলের পাশে নিম-ডালের দাঁতন হাতে কেউ দাঁত ঘষছে। কেউবা এই সময়, ভীড় বারবার আগে ভাগেই ক' ঘটি জল ঢেলে নিয়েছে মাথায়। তাইতো ... ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে আসছে নগরীতে।

কি মুশকিল, এই সময় এক কাপ চা-ও মেলা ভার। বনফুল রেস্টুরেন্টটা পর্যন্ত খোলে নি এখনও। চেয়ারগুলি সব টেবিলের ওপর।
যাক, পাসগুলো সব চেঞ্জ করা হয়েছে ... শো সাড়ে দশটায়। সিনেমা হলের সামনে এতটা ভীড়ও নেই। এ ছবি অনেকে বহু বার দেখেছে। তবুও কিছু লোক আবার এসেছে দেখতে। হয়তবা কোন্‌ স্মৃতি জড়িত রয়েছে এর সাথে।
কটা মিনিট বাকী আছে সিনেমা হলের প্রথম অ্যালার্মটা পরতে - এখন ওরা এলেই হয়। অবশ্য এত তাড়াতাড়ির কিছু নেই... প্রথমে ত' ট্রেলার চলবে ওগুলো মিস্ করলে ক্ষতি নেই। তবুও, অন্ধকার হলে লোকের পা মাড়িয়ে সিট খোঁজা বড় যাচ্ছেতাই ব্যাপার! ...ভাবতে ভাবতেই যাদবপুরের বাসটা এসে পড়ল।
- এই দীপদা! আমরা হাজির - জনাব!
- তাইতো, দেখছি সুখের ঘুমটা ভেঙ্গেছে সময় মত!
- আর বল কেন! ভাল করে ঘুমোতেই দিল না। ভোর না হতেই- চেঁচামেচি, ধাক্কা-ধাক্কি একেবারে হুলস্থুল কাণ্ড।ভাল করে একটা চা পর্যন্ত খাওয়া হয় নি। মা-টা একেবারে ...
নাসিম মাসী হেসে বললেন-
- যত দোষ নন্দ ঘোষ - তাই না! সকাল সকাল না ওঠালে ত' আজ আর আসা হ'ত না, মর্ণিং-শো তো দূরের কথা, ম্যাটিনী-ও হ'ত কিনা সন্দেহ ... সাজ-গোঁজ করতেই ত তোর দশ ঘণ্টা সময় লাগে। আর চা পাস নি আজ!
- আরে চা খাই নি তা কে বলেছে! ভাল করে আমেজ করে খাওয়া হয় নি ... আর, বাইরে বেরুতে গেলে একটা ভাল কিছু তো পরতে হবে। রোজ রোজ তো আর সিনেমা দেখতে যাচ্ছি না!
- বেশ, বেশ এবার চল তো সবাই ভিতর য়াই। চা আমার-ও ঠিকমতো খাওয়া হয় নি। ...আর আমীর ব্যাপার কি! তুমি বোবা হয়ে গেলে নাকি! একদম স্পীক-টি নট।
- বলবার সুযোগ থাকলে ত' বলবো। জয়া আর মা শুরু করলে - আমি নো হয়্যার। চল হলে যাওয়া যাক।

কিছু কিছু ফিল্ম আছে, যে গুলো দেখবার পরে আর মেয়েদের চোখের দিকে তাকানো চলে না। এই ছবিটাও সেই জাতীয়, নাসিম মাসীর ছল-ছল চোখ দেখে সঙ্কোচ হল দিবাকরের। পরিস্থিতি একটু সহজ করতে হবে...
- ওঃ, গলাটা শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে আছে। চলুন মাসীমা কোথাও বসে এক কাপ চা-কফি খেয়ে নেওয়া যাক। আমরা সবাই গড়িয়াহাট নেমে পরলে কেমন হয়? পথেই পরছে!
- হ্যাঁ, সেটাই ভাল। কফি তাহলে আমরা ঐ সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট-এ খাব ... কি মা?

আমীরের প্রস্তাবটা খারাপ ছিল না। গড়িয়াহাটএর সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টটা বেশ ছিম ছাম, চলছে বেশ। সন্ধ্যা বেলায় একটা খালি টেবিল মেলা ত' প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার। আমীরের মতে - সবাই যখন এক সাথে রেস্টুরেন্টে কফি খাচ্ছে, তাহলে এর সাথে একটা ঢোসা মন্দ হয় না। তাই-ই হল- ঠিক। দুপুরের রান্নাটা স্থগিত রইল।

- যাও দীপদা, এবারের মত তোমার রেহাই হল।
- মানে?
- মানে, আজ আর তোমাকে রান্নাঘরে কেরামতি দেখাতে হবে না। আমরাও বাঁচলাম আজ আর উপোস দিতে হবে না - সবাইকে। তবে তোমায় ছাড়ছি না আমরা - তোমার রান্নার খেল না দেখে ছাড়ছি না - কিছুতেই।
- বড় জ্বালাতন করিস তোরা দীপকে...
- আঃ মাসীমা, পাগলের কথা ছেড়ে দিন ... কিন্তু আপনার কি হল! মন মেজাজ ভাল নেই নাকি!
- না রে, তা নয়। ভালই লাগছে সবই ... তবুও এখানে, সব কিছুর সাথে জড়িয়ে রয়েছে অনেক স্মৃতি ... মনে হয় এই সে দিনের কথা। সিনেমা দেখা, কফি হাউস, মার্কেটের সামনে অথবা গোলপার্কের কাছে রাস্তায় ফুলওয়ালার রজনীগন্ধা আর জুঁই-এর মালা, অকারণে ছাতা থাকতেও বৃষ্টিতে ভেজা। কতবার যে এই রাস্তায় সুব্রতর সাথে হেঁটেছি ... কখনও ঐ পানের দোকানে কোল্ড ড্রিংস্ কখনও রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়া... এই সব স্মৃতি ভেসে আসে। আমরাও ছিলাম এক কালে আড্ডাবাজ। এ সব কথা মনটাকে একটু উদাস করে দেয়।
জয়া একটু পাশ ঘুরে দাঁড়াল... টস টস করে ঝরল ওর চোখের ক' ফোঁটা জল...। মা-কে দেখেছে ও কঠিন হাতে সব ঝড়-ঝাপটা সয়ে কাজ করতে ... এমন তরো আবেগ ভরা প্রাণে দেখে নি কখনও।

... তবুও সুন্দর ছিল মর্ণিং-শো, সুন্দর ছিল দিনটা।

***
ক্রমশ

পথে-ঘাটে ৪ ... বৌ-দি

পথে-ঘাটে


বৌ-দি

ভোর না হ'তেই কোথা থেকে সব হতচ্ছাড়া পাখিগুলো সার বেঁধে জড়ো হয়েছে- আর ওগুলোর দাপাদাপি দিল ত' সকালের স্বপ্ন-টাকে বরবাদ করে। আহা, ... "পাখি সব করে রব" ... যত্ত সব। সদ্য ঘুম ভাঙ্গা দিবাকরের সব রাগ টাগ গিয়ে পরল রবীন্দ্রনাথের ওপর। কি আর করা যায়! শনিবারের সকাল একটু টেনে ঘুমাবে তারও উপায় নেই ওই হতভাগাগুলির জ্বালাতে। যাক গে তাহ'লে নাহয় সকালের কাজটা করেই নেওয়া যাক্ ... তোয়ালেটা আবার গেল কোথায়? ... ওদিকে আবার দরজায় ঠক্-ঠক্। কি হ'ল সবাইকার... এই শনিবারের সাত সকালে!

- আরে ও দিগ্‌গজ বাবু দরজাটা খোল তো ... তোমার চা নিয়ে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব!

দরজাটা খুলতে খুলতেই বলল দিবাকর -
- ওঃ বৌ-দি, সরি, সরি ... বাঁচিয়ে দিলে তুমি আমাকে। চা-এর সাথে তোমার পায়ের ধুলোও দাও।
- তোমার জন্যে তা আর আনা হ'ল না। বৃষ্টি হচ্ছে ... সব ধুয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। কি করি!
- তা'হলে তোমার পায়ের ছাপটাই দাও না . বাঁধিয়ে রাখব।
- আরে, আমার পায়ের ছাপ দিয়ে তোমার কি হবে ... অন্য কারও থেকে যোগাড় করে নাও।
- ও বৌ-দি মনি, সে ছাপ কি আর কাগজে থাকবে! সে ছাপ তো আঁকবে মনে।
- তা-ই তো... কোন ফিল্ম-এর ডায়লগ হল এটা? নাও, চা-টা খেয়ে নাও ... ওটা ত' জল হ'তে চলেছে।
- তুমি দরজাটা ভেজিয়ে দাও না, গো! আমি বারান্দাতে বসে খেয়ে নিচ্ছি...
- হ্যাঁ, বুঝেছি .. চা-এর সাথে সিগারেট ব্রেক ফাস্ট! তোমার লাংক্স-টা গেল, আর কি।
- বৌ-দি, বৌ-দি, পরাও ফিলজফি ... এনাটমি জানলে কবে থেকে।
- বাঁদর! ইয়ার্কি হচ্ছে ... বলছি তোমার দাদাকে, তোমার ব্রেক ফাস্টের কথা। ...
- বোল না বৌ-দি, লক্ষী বৌ-দি টি।
- যাও... যাও!

মনে পরতে-ই ছ্যাঁত্ করে উঠল দিবাকরের বুকটা। সে পায়ের ধুলোও ধুয়ে গেছে ... সে পায়ের ছাপও পরে না আর ... কোথা-ও না। খাঁ-খাঁ কর উঠল মনটা।

শনিবার বন্ধ থাকত অফিস, একটু বেশী সময় মিলত উইকএন্ড-এ। একটু আলসেমি করা, বাজার করা, বৌ-দিকে জ্বালাতন করা তারপর চলত এদিক ওদিক আড্ডার আসর। সকাল থেকেই ঝিম ঝিম করে বৃষ্টি। কখন যে থামবে তার নেই কোনও ঠিক ঠিকানা, আজ বিকাল চারটায় আবার আমীর-দের বাড়ি যাবে... কথা দিয়েছে। ধুর, খেয়ালই হয় নি জিজ্ঞেস করতে বাড়িতে কে কে থাকে। নাই বা হ'ল, ... খোলা মনের লোক হবে হয়ত সবাই। নইলে কি আর দুম করে, বলতে গেলে প্রায় এক অচেনা অজানা লোককে, নিমন্ত্রণ করে বসবে! পথে সত্যনারায়ণ-এর মিষ্টির দোকানটা চোখে পরতে বেশী বাড়াবাড়ি না করে গোটা কয়েক চমচম আর সিঙ্গাড়া কিনে নিয়ে হাঁটা দিল।

আঃ, আমীরের ঠিকানার কাগজটা ভিজে গিয়েছে একটু - বাড়ির নম্বরটা ঠিকমত পড়া যাচ্ছে না। নামটাতেও কেমন খটকা লাগছে ... খান চক্রবর্তী! তা আর কি হবে খটকা লাগলে। এক ছোট ছেলেকে জিজ্ঞাসা করতেই বলল-
- ওঃ নাসিম মাসীর বাড়ি। ঐ ত' দুটৌ বাড়ির পরেই।
যাক বাবা - ওরা এখানে বেশ পরিচিত বলে মনে হচ্ছে।

কলিং বেল টেল নেই - দরজা নক্ করতেই এক ভদ্রমহিলা দরজা খুলে হাসিমুখে বললেন -
- দিবাকর বুঝি! এস ... তুমি করেই বললাম কিন্তু। আমি আমীর-এর মা।
- আর এ পাড়ার মাসীমা?
- ওরে বাবা, সে খবর দেখছি ইতিমধ্যে পেয়ে গিয়েছ!
- তাহলে আমিও আপনাকে মাসীমা বলব!
মিষ্টির প্যাকেটা নাসিম মাসীর হাতে দিয়ে দিবাকর মৃদুস্বরে বলল-
- আর মাসীমা, এ গুলো পথে পেয়ে গেলাম...

আমীর বসার ঘরে ঢুকতেই নাসিম মাসী -
- দেখেছিস দিবাকরের কান্ড!
- কী কাণ্ড-ফাণ্ডর কথা বলছ মা! দিবাকরকে তো বসতেই বল নি।
- আরে তাইতো.. ছিঃ ... তুমি বস দিবাকর। কথা বল তোমরা, আমি আসছি একটু বাদে।

বেশ ছিম ছাম বসবার ঘরটা। অতিরিক্ত আসবাবের বালাই নেই একদম ... একটা কাচের আলমারি। ঠাসা বই। আর একটা ফ্রেমে বাঁধান ছবি ... দিবাকরের উত্‌সুক দৃষ্টি নজরে এসেছে আমীরের।

- আমার বাবার ছবি। সুব্রত... সুব্রত চক্রবর্তী ছিল তাঁর নাম।

দিবাকর তাকাল আমীরের দিকে।

- সে অনেক দিনের কথা..., মানে আমি তখন খুব ছোট, আর জয়া আমার বোনটা তো ছিল আরও ছোট। উনি আমাদের ছেড়ে গিয়েছেন। আর আমাদের বড় করবার সব ভার বইতে হয়েছে মা-কে। একাই।

আরে দেখেছ জয়া ওর বইগুলি টেবিলটার ওপর ছড়িয়ে রেখেছে।

- আরে, তাতে হ'লটা কী! তোমার বন্ধু কি বইগুলো পরে ফেলবে... ক্ষতি কি তাতে, জ্ঞান বাড়বে। এই নাও চা নিয়ে এসেছি সবার জন্যে ... সার্ভ-টার্ভ কিন্তু তোমাদেরকেই করতে হবে।

টেবিলের ওপর ট্রে-টা রেখে। জয়া গিয়ে বসল ধপাস করে একটা চেয়ারে।

নাসিম মাসী এক থালা বোঝাই পেঁয়াজি আর কতগুলি ছোট প্লেট নিয়ে হাজির।
- এগুলো সব জয়ার করা।
- কি বলছেন মাসীমা... জয়া এ সব করতে পারে!
- মা, দেখেছ - দাদা-টা কাকে ধরে নিয়ে এসেছে। ... আঃ তোমার অত্তবড় নাম কিন্তু আমি বলতে পারব না। কী বলা যায়! ... দিবা। নাঃ দীপদা বলবো তোমাকে। রাজী তো!
- রাজী তো!... খুউব রাজী। দীপ ...ই আমার ডাক নাম... প্রিয় নাম।
- আরে দীপদা ... নামটা তো প্রিয় তা লোকটাকে ত' প্রিয় হতে হবে।

নাসিম মাসী হাসতে হাসতে ভর্তসনা সুরে জয়াকে বললেন
- তোর ঠোঁটটা কাটা... প্রিয় হতে হবে কী রে ... প্রিয় করে নিতে হবে যে।
- জয় হোক মাসীমার।

এই হাসি ঠাট্টা আর কয়েক দফা চা-পেঁয়াজিতে বিকেলটা কেটে গেল আর তারই সাথে সব দূরত্ব ... এক নিমেষে।

***

এরপর কতবার যে দিবাকর আমীরদের বা[ড়ি গিয়েছে ক' গ্যালন চা আর মুড়ি, তেলেভাজা শেষ করেছে তার হিসেব আর কে রাখতে যাচ্ছে। একদিন সন্ধ্যায় গড়িয়াহাটের রাস্তায় দিবাকরের সাথে ফুর-ফুর করে ঘুরে বেড়াবার সময় জয়া বলল...

- এই দীপদা, মাকে একবার টেনে হিঁচ্‌ড়ে বাড়ি থেকে বার করা যায় না! গোটা সপ্তাহ স্কুল, টিউশনি। তাছাড়া ক'টা গরীব ঘরের ছেলে-মেয়েকে ফ্রী-তে পড়াশুনা শেখায়। অবশ্য মা-র সময় না থাকলে বাচ্চা-গুলোকে আমরা একটু আধটু হেল্প করি। আসলে ওটা কিন্তু মা-কেই হেল্প করা। আর জান দীপদা ছেলে-মেয়েগুলি আমাদেরকে বেশ ভালবাসে। দাদা-টা একদম হাঁদা... ওর কোনও প্ল্যান-ফ্যান মাথায় আসে না।

- তোমার মাথায় বুঝি খুব প্ল্যান আসে?
- ঐ যে, তোমাকে বললাম ... বাড়ির একজন করলেই হল আর কি।
... বাড়ির একজন করলেই হল! হ্যাঁ, দীপকে ত' ওরা বাড়ির একজন-ই ভাবে, মানে তার বাইরে আর ভাবতেই পারে না।
- সিনেমা গেলে কেমন হয়!
- আরে দীপদা, তুমিও দেখছি বুদ্ধু ... মা বেরুবে আমাদের সাথে সিনেমা দেখতে। কি বুদ্ধি আমার ... পাগোল না, মাথা খারাপ!
- ও.কে. জয়া ট্রাই করে দেখা যাক না ... তারপর, না হয় দেখা যাবে বুদ্ধির ঢেঁকিটা কে! ... আরে, আর কতক্ষণ এই গড়িয়াহাট মোড়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেওয়া যায়!
- তাই তো, চল বাড়িতে চা খাওয়াবো।
- না, আজ থাক সেটা, তার চেয়ে চল বরং ঐ রেস্টুরেন্টটাতে এক কাপ চা আর একটা ভেজি-চপ মেরে দিই।
- আমি তাহলে প্রন নেব।

***

- ঐ তো ৫ নং বাসটা আসছে... আমি কাটছি দীপদা। তুমি কাল বিকেলে আসবে কিন্তু... অফিস থেকে সোজা।

- না, বাড়ি হয়ে আসব। বৌ-দি টা বসে থাকবে নইলে। ... চলি।

***

রাস্তা তেমন জ্যাম ছিল না, অফিস থেকে সকাল সকাল-ই ফেরা গেল। বাড়ি আসতে না আসতেই বৌ-দির হাতের চা এসে হাজির।
- বৌ-দি, আমি চা টা খেয়েই বেরিয়ে পরব, মানে এক্ষুণি ...
- আহা, ঘোড়াটা যে বেধে রেখে এসেছ, বুঝতেই পারছি। তা, কোথায় যাওয়া হচ্ছে দিগ্‌গজ বাবুর... শোনা যায়!
- আরে কোথাও না, ... ঐ জয়াদের বাড়িতে।
- জয়া! আজকাল দেখছি ঘন ঘন জয়া... জয়ার জয়ধ্বনি নাকি!
- আরে, দ্যুৎ বৌ-দি, কি যে বল। ওরা আমার দারুন বন্ধু... ও সব কিছু নয়। কিছু থাকলে তোমাকে বলব না - তাই হয় না কী!
- তাই বুঝি?
- তাই তো, বৌ-দি তো বন্ধু ... "এমন বন্ধু আর কে আছে?..."
- আঃ বড় ফাজলামি তোমার ...সব সময় সিনেমার ডায়লগ!
- ফাজলামি! বৌ-দি মানে কি জান! বস, আরে বস না বৌ-দি ... বলছি তোমাকে, মন দিয়ে শোন, একদম মন দিয়ে শুনবে কিন্তু। বৌ-দি হচ্ছে... একটা মানুষের মধ্যে বন্ধু, ভাই, বোন, দিদি এমন কি মা-ও, হ্যাঁ মা বলো বন্ধু বল সব কিছু।... আর.

... নজরটা পড়ল বৌ-দির দিকে... ফ্যাঁত ফ্যাঁত করে কাঁদছে।

- কাঁদছ বৌ-দি!
- নারে বোকা, কাঁদছি না ... এটা আনন্দ। হাঁদারাম কোথাকার!! যাও এখন তাড়াতাড়ি ফিরবে কিন্তু।
-আচ্ছা... চেষ্টা করব।

***

... ক্রমশ

পথে-ঘাটে ৩ ... তেলেভাজা

পথে-ঘাটে



তেলেভাজা

রাত হয়েছে অনেক। কেন যেন দিবাকরের ঘুম ভেঙ্গে গেল, ট্রেনের ঝাঁকুনিতেই হবে। বাইরে আলো-আঁধারের লুকোচুরি চলছে। চাঁদনী রাত কিন্তু এ চাঁদ এক লাজুক মেয়ের মত থেকে থেকে ঘন মেঘের ওড়নার অন্তরালে তার হাঁসিটাকে লুকোবার চেষ্টা করছে। আবার কখনও মুচকি হেসে আকুল করছে প্রেমিক প্রেমিকার কল্পনা-জগতকে। আকাশ ছড়ানো মেঘের দল জোট বেঁধেছে এলোমেলো হাওয়ার সাথে, মেতে উঠেছে সকলে লুকোচুরি খেলায়। দুই-এক ঝাপটা বৃষ্টিও হয়েছে মনে হয়, আলো-আঁধারে ঝিলমিল করছে লাইনের ধারে সার দিয়ে দাঁড়ানো গাছের বারিসিক্ত পত্ররাশি। আলো-আঁধিয়ার খেলার পর্ব শেষ হয়নি এখনও ... রাত এখনও বাকি।

কোথাও মেঘাচ্ছন্ন অম্বর হার মানিয়েছে চাঁদটাকে সেই লুকোচুরি খেলায়... আঁধারের কোলে বিলীন হয়েছে আকাশ আর মাটির দূরত্ব... নেই কোনও দিক আর দিগন্ত। গ্রামগুলি কোনও অব্যক্ত বেদনা গোপন করতে পিছিয়ে পড়ছে পথের মাঝে। তারই অশ্রুসঞ্চিত বারিধারা ক্ষীণবেগে বইছে আঁধারের বুকে মৃদুস্পন্দন জাগিয়ে। দৃষ্টিগোচর না হলেও স্পর্শ করে সে স্পন্দন অনুভূতিকে ... তার ঢেউ জাগায় হৃদয়ে দোলা...আলো-আঁধারের অস্ফুট হাতছানির নীরব আকর্ষণ নিয়ে চলে দূরে, বহু দূরে। ব'য়ে আনে স্মৃতির উৎস হ'তে কখনও আনন্দ কখনও-বা বেদনা-জড়িত পরশ। এ-তো নয় শূন্যতা ... এ হ'ল বলা আর না-বলা কথার গ্রন্থিত ছন্দ।

হেথা-সেথা রাতের সে মৌনতা ভঙ্গ করা ঝিঁ-ঝিঁ পোকার মুখরতা ... তবুও হয়না ছন্দপতন।

কোথাও... হাজারো জোনাকি এক টুকরো তারকাময় আকাশের মত ছেয়ে আছে বনানী, ... মিলনপ্রয়াসীর তৃষ্ণা জাগিয়ে। এ এক অদ্ভুত দৃশ্য। যেন আঁধারের বুকে ছড়ানো রাশি রাশি খসে পরা তারা আঁধারঘন গ্রামগুলিকে মৃদু আলোকের বরণ ডালিতে মনোরম করে তোলার প্রচেষ্টারত। আলো-আঁধারের প্রণয়ের মৌন নিবেদন।

ট্রেনের কামরার রাতের আলো জ্বলছে পিট-পিট করে, প্রায় সব যাত্রীরা নিদ্রামগ্ন। যাত্রীরা তাদের বাক্স-পেঁটরা সব শিকল-তালাবদ্ধ করে বাক্স হারানোর চিন্তা থেকে খালাস। কোথাও এক-দুই বাচ্চা কারণ অকারণ ট্যাঁ-ট্যাঁ করছে। কিছু যাত্রী জায়গা না পেয়ে কামরার মেঝেতেই শুয়ে পড়েছে, খবরের কাগজ বিছিয়ে। ট্রেনে দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় এসব এখনও বরদাস্ত করা হয়। আর এতে কারই বা ক্ষতি! ট্রেনই তো দেশের সব স্বল্পবিত্ত্বের সাধারণ মানুষের একমাত্র পরিবহন। ট্রেনের সংখ্যাও পরিমিত তাই এ সহনশীলতার সমালোচনা নিষ্প্রয়োজন।

গাড়ির দোলা ঘুমের আবেশে জড়িয়েছে সবাইকে। রাতের প্রহরীরা টহল দিচ্ছে মাঝে মাঝে, তাদের বন্দুক পিঠে ঝুলিয়ে।

ঘুমটা সম্ভবতঃ আর আসবে না। দিবাকর চেয়ে আছে বাইরের দিকে... আঁধারটা ঘনিয়ে আছে এখনও, নেই কোথাও এক ছিটে আলো। এক বহু পরিচিত গানের কথা মনে পড়ছে... "অন্তরেতে দেখবো যখন আলোক নাহিরে ..." রবি ঠাকুরের গান এটা... যে গেয়েছিল তাকে দিবাকর দেখতে শুরু করেছিল, "...চোখের বাহিরে" আর "অন্তরেতে..."।

গ্রাজুয়েশন-এর পর শুরু করেছে একটা ইন্টারন্যাশানাল কোম্পানিতে এক্সীকিউটিভ ট্রেনী হিসেবে। বন্ধুর কমতি ছিল না ওর কোনও দিন... আর তারই সাথে ছিল ফটোগ্রাফীর ঝোঁক্। টালীগঞ্জের ফিল্ম-স্টুডিও পাড়ার ছেলে, ফিল্ম পেত অঢেল। বন্ধুরাই যোগান দিত তার - তাই ছবি তুলবার কৃপণতা ছিল না একদম। অবসর সময়ের অনেকটা কাটত বন্ধুদের সাথে কফি-হাউসের আড্ডাতে, এদিক বন্ধু-বান্ধবীদের বাড়ির চা, ঝাল-মুড়ি আর পেঁয়াজীর আসরে। আরে শুধু কি চা, অনেক সময় মা-মাসী বা বোন, বৌদি-রা ভাল-মন্দ না খাইয়ে ছাড়ত না একদম-ই। একবার কোনও বাড়িতে পা মাড়ালেই হ'ল... বলে না, কোনও বাড়িতে আসাটা নিজের ইচ্ছায় - কিন্তু যাওয়াটা নয়। তাই-ই হ'ত। সব পরিবারে ত' আর অন্নপূর্ণার ডালি থাকে না - তবুও টানা-টানির দিনেও, আকালের কালেও নিজের খাবার ভাগ করে খায় অতিথির সাথে ... এ যে এক অলিখিত প্রথা। খাওয়ার থেকে খাওয়ানোর আনন্দ মেয়েদের, এ তো রয়েছে দেশের প্রতিটি ঘরে। সত্যি বলতে কি, এই আদরে ডাল-ভাতকেও অমৃত বলে মনে হয়। নাই বা হ'ল বিরিয়ানী, ফ্রায়েড-চিকেন... মা-মেয়েদের আন্তরকিতায় তাদের হাতের ছোঁয়ায় সব কিছুই হয়ে ওঠে যেন পরমান্ন। ওদের গড়িয়ে দেওয়া এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল আনে র‌্যালি সিং-এর লস্সীর থেকেও বেশি তৃপ্তি। অন্ততঃ দিবাকরের তো তাই মন হ'ত।

এরই মাঝে, দিবাকর সপ্তাহের দুটো দিন টুক্ করে কেটে প'রত ক'টা ঘণ্টার জন্যে। এ সময়টা ছিল ম্যাক্স-মূলার ভবনে জার্মান ক্লাসের জন্যে বাঁধা... ভাষার সাথে ছিল হয়ত ওখানে আরও অন্য কিছুর টান। ... যাক্, সেটা আবার পরে কখনও তলিয়ে দেখা যাবে।

মোট কথা দিনগুলি ছিল প্রোগ্রাম-বিহীন প্রোগ্রামে ঠাসা মানে যাকে বলে - প্যাক্ড্-আপ।

এরই মাঝে এলো বড়দিন - পঁচিশে ডিসেম্বর। হৈ-হুল্লোড় করে চারজন বন্ধু মিলে যাওয়া হ'ল চিড়িয়াখানায় ... ফটো তোলার নাকি দারুণ ব্যাকগ্রাউন্ড। হ্যাঁ, গেট পেরিয়ে ঢুকতে না-ঢুকতেই ব্যাকগ্রাউন্ড-এর উদয়... চপলতা উচ্ছ্বসিত হাসি আর কলরবে মাতিয়ে জন পাঁচেক কলেজ ছাত্রীর প্রবেশ দৃষ্টি আর শ্রবণীর আকর্ষণ করেছে সেকথা বলাই বাহুল্য।
***
বেশ চলছিল ট্রেনের ঝাঁকুনি আর দোলা, ... তা মোটামুটি ভালই লাগছিল। এ দোলার আবেশেই হবে হ'য়ত, সব যাত্রীগুলো.. ঐ হ'ল, সবাই না হোক, বেশীর ভাগ... হ্যাঁ, প্রায় সবাই ঘুমচ্ছে বেহুঁশের মত। আর ফেলে আসা দিন দিনগুলি সুযোগ পেয়ে ঘুর-ঘুর করে লাইন মারছে দিবাকরের স্মৃতির দুয়ারে। একবার এ দুয়ার খুললেই হ'ল... হুড়-মুড় করে স্মৃতিগুলো... না, আর ঢুকবার অবকাশ পাবার আগেই - ক্যাঁর-খ্যাঁর করে ব্রেক মেরে থেমে গেল গাড়িটা... রেড সিগন্যাল হবে হয়ত।

একটু যে তন্দ্রার ভাব এসেছিল, তাও উবে গেল - নিঃশেষে।

বাইরে এখনও অন্ধকার, টিপ-টিপ করে বৃ্ষ্টিও পড়ছে। ট্রেনের জানালাটা ভিজে রয়েছে, কামরাটাতে ভেপসা গন্ধ, ফ্যানগুলো সব ঘুরছে ঠিকই কিন্তু জানালাগুলি বন্ধ থাকলে এর কি আর কোনও সুরাহা হয়! যাকগে, ট্রেনটা থামায় একটু নিস্তার ত' পাওয়া গেল - মন্দেয় ভালো।

... বর্ষণমন্দ্রিত কলকাতার সে দিনগুলির আবেশ এখনও মলিন হ’য়ে বিলীন হয়নি অতীতের আঁধারে। সারাটা দিন রিম-ঝিম বারীশ, মেঘের ঘনঘটা আর তারই ফাঁকে ফাঁকে কখনও লাজুক অরুণ-কিরণ; সিক্ত সরণী – এথা হোথা পীচ ভাঙ্গা রাস্তায় জমে থাকা ঘোলা জল, বাসে ট্রামের ভিড়ে গুঁতো-গুঁতি, কোনায় কোনায় হরেক রকম সোঁদা সোঁদা গন্ধ। এদিক সেদিক পথধারে ফুলের ব্যাপারি —জুঁই আর রজনীগন্ধার সৌরভ । সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বিলিয়ে চলেছে মেয়েদের কবরীর সিক্ত যূথিকা তার আবেশভরা সুবাস। বষর্ণমুখর দিনশেষে পথের ধারে ছাপরা থেকে ভেসে আসা তেলেভাজার গন্ধ... লোভনীয় সে আকর্ষণ উপেক্ষা করার উপায়টা খুঁজে পাওয়া খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়!! পথপ্রান্তে তেলেভাজার বাস বশ করেছে সকল ঋতুতেই — শীতের কুয়াষাচ্ছন্ন সন্ধ্যায় মুখরোচক সে ভাজা আর্দ্র করে তুলেছে মুখটা বারংবার; আঃ – তুলনাহীন ... হ্যাঁ ঐ চার-পাঁচটা তারা ঝোলানো আর জেল্লা ধরানো রেস্টুরেন্টগুলিও সে তৃপ্তি যোগাতে পারবেনা, একথা কিন্তু হলপ করে বলা চলে।

এমনই এক ঝিম্-ঝিমে বৃষ্টিঝড়া সন্ধ্যায় বাস স্ট্যান্ডের পাশের ঐ নামকরা তেলে ভাজাওয়ালা দৃষ্টিগোচর হওয়া মাত্রই রোশনি-ইন্দ্রিয় সাড়া দিয়ে উঠল - তা হবে না! ওর ভাজার জন্যে হরদম ভীড় থাকে। এই বৃষ্টিতেও দাঁড়িয়ে আছে গোটা-কয়েক ছেলে-মেয়ে লোভ সামলাতে না পেরে। এক ঠোঙা গরমা গরম তেলেভাজা... দামটা দিতে গিয়ে দশটা পয়সা কম পড়ছে। কি আর করা যায়... দশ টাকার নোটটা বার করতেই- ভাজিওয়ালা নারাজ।

- দশটা পয়সার জন্যে দশ টাকার ভাংতি দিই ... এ কেমন কথা হ'ল, বলুন তো।
- আরে, আমার যে আর ভাংতি পয়সা নেই - তা হলে একটা ভাজি কমিয়ে দিন...

পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা হাওয়াই শার্ট পরা ছেলেটা, তার জন্যে এগিয়ে দেওয়া ঠোঙাটা নিতে নিতেই বলে উঠল -
- নাঃ, কমাবার দরকার নেই... ঐ দশটা পয়সা আমিই দিচ্ছি।
- বা, রে! তুমি কেন দেবে!
- তোমার ওই দশ পয়সার জন্যে দশ টাকার ভাংতি তো কোথাও মিলবে না। পাশের ওই চা-এর দোকানটাতে গিয়ে বস ত' দেখি... আমি আসছি দামটা মিটিয়ে। তখন সব হিসেব নিকেশ হবে।
অগত্যা দিবাকর গিয়ে বসল একটা বেঞ্চে ... তেলেভাজাটার ঠোঙা হাতে। দু-গ্লাস চা-এর অর্ডার দিয়ে ছেলেটা, মানে হাওয়াই-শার্ট পরা যুবক-ছেলেটা এসে বসল দিবাকরের মুখোমুখি মানে উল্টোদিকের বেঞ্চে।

- বাঃ, তুমি ত' আবার চা-এর অর্ডার দিলে ... দামটা দিই কি ক'রে! আমার তো...।
- দশ টাকার নোট! এই তো! ভাঙ্গতে আর হবে না ... পয়সাটা আমিই দিচ্ছি। ভাজির সাথে চা না হলে কি আর ভাল লাগে!
- হ্যাঁ, ঠিক তা ব'লে...
- আরে, ঠিক আছে, ঠিক আছে ... যদি তোমার আঁতে ঘা লেগে থাকে, তাহলে আমার বাড়ি গিয়ে হিসেবটা মিটিয়ে দিয়ে আসবে।
আমার নাম আমীর... এই আমার ঠিকানা - যাদবপুরে ....

একটা কাগজে খস্-খস্ করে ঠিকানাটা লিখে দিবাকরের হাতে ধরিয়ে দিল। কাল শনিবার, বিকেল চারটে নাগাদ চলে এস।
লোভে পরে অনেকগুলো ভাজা কেনা হয়ে গিয়েছে। কাছেই দুজন বাস কন্ডাক্টর চা খাচ্ছিল। ভাজির ঠোঙা দুটো এগিয়ে ধরে বলল..

- ও, দাদা! তেলেভাজা খাবেন! আমাদের খুব বেশী হয়ে গিয়েছে।
- কি হ'ল পারছেন না, নাকি?
- না, খুব পারছি, কিন্তু বাড়িতে যে অমৃত পরে আছে ... সে গুলোর কি হবে?

বাড়িতে মেয়েরা খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে তাদের প্রিয়জনের ঘর ফিরবার পথ চেয়ে। ভাল-মন্দ কিছু রান্না হয়েছে সারাটা সন্ধ্যা জুড়ে - কয়লা অথবা কাঠ-খড়ির ধোঁয়াতে চোখ কচলাতে আর চোখের জল ফেলতে ফেলতে। চপ-কাটলেট না হলেও ও খাবার না খেয়ে কোনও উপায় নেই। নইলেই, হ'ল আরকি - মান-অভিমান, চোখের জল, যেন জ্যান্ত মানুষটার আস্ত হৃৎপিণ্ডটা টেনে-হিঁচড়ে বার করা হ'য়েছে... এই তো ব্যাপার। সব বাড়িতেই চলছে এসব ... মানে, যে সব পরিবারে আধুনিক সাহেবিয়ানার ঢুকবার সুযোগ এখনও মেলে নি। তা, এ কথা ওই কন্ডাক্টরদের-ও অজানা ছিল না ...

- দিন তা হ'লে ... ধন্যবাদ...

চা, মানে কন্ডেন্সড মিল্ক আর চিনির সুপের গ্লাসে শেষ চুমুকটা দিয়ে হাঁটা দিল' ওরা বাড়ির দিকে।
- তা হলে কাল বিকেলে ...
- ও. কে.

***

ক্রমশ