দেশ বিদেশ, পথে-ঘাটে, লেখনী, প্রবাসীর চিঠি

Thursday 17 December 2009

পথে-ঘাটে ৪ ... বৌ-দি

পথে-ঘাটে


বৌ-দি

ভোর না হ'তেই কোথা থেকে সব হতচ্ছাড়া পাখিগুলো সার বেঁধে জড়ো হয়েছে- আর ওগুলোর দাপাদাপি দিল ত' সকালের স্বপ্ন-টাকে বরবাদ করে। আহা, ... "পাখি সব করে রব" ... যত্ত সব। সদ্য ঘুম ভাঙ্গা দিবাকরের সব রাগ টাগ গিয়ে পরল রবীন্দ্রনাথের ওপর। কি আর করা যায়! শনিবারের সকাল একটু টেনে ঘুমাবে তারও উপায় নেই ওই হতভাগাগুলির জ্বালাতে। যাক গে তাহ'লে নাহয় সকালের কাজটা করেই নেওয়া যাক্ ... তোয়ালেটা আবার গেল কোথায়? ... ওদিকে আবার দরজায় ঠক্-ঠক্। কি হ'ল সবাইকার... এই শনিবারের সাত সকালে!

- আরে ও দিগ্‌গজ বাবু দরজাটা খোল তো ... তোমার চা নিয়ে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব!

দরজাটা খুলতে খুলতেই বলল দিবাকর -
- ওঃ বৌ-দি, সরি, সরি ... বাঁচিয়ে দিলে তুমি আমাকে। চা-এর সাথে তোমার পায়ের ধুলোও দাও।
- তোমার জন্যে তা আর আনা হ'ল না। বৃষ্টি হচ্ছে ... সব ধুয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। কি করি!
- তা'হলে তোমার পায়ের ছাপটাই দাও না . বাঁধিয়ে রাখব।
- আরে, আমার পায়ের ছাপ দিয়ে তোমার কি হবে ... অন্য কারও থেকে যোগাড় করে নাও।
- ও বৌ-দি মনি, সে ছাপ কি আর কাগজে থাকবে! সে ছাপ তো আঁকবে মনে।
- তা-ই তো... কোন ফিল্ম-এর ডায়লগ হল এটা? নাও, চা-টা খেয়ে নাও ... ওটা ত' জল হ'তে চলেছে।
- তুমি দরজাটা ভেজিয়ে দাও না, গো! আমি বারান্দাতে বসে খেয়ে নিচ্ছি...
- হ্যাঁ, বুঝেছি .. চা-এর সাথে সিগারেট ব্রেক ফাস্ট! তোমার লাংক্স-টা গেল, আর কি।
- বৌ-দি, বৌ-দি, পরাও ফিলজফি ... এনাটমি জানলে কবে থেকে।
- বাঁদর! ইয়ার্কি হচ্ছে ... বলছি তোমার দাদাকে, তোমার ব্রেক ফাস্টের কথা। ...
- বোল না বৌ-দি, লক্ষী বৌ-দি টি।
- যাও... যাও!

মনে পরতে-ই ছ্যাঁত্ করে উঠল দিবাকরের বুকটা। সে পায়ের ধুলোও ধুয়ে গেছে ... সে পায়ের ছাপও পরে না আর ... কোথা-ও না। খাঁ-খাঁ কর উঠল মনটা।

শনিবার বন্ধ থাকত অফিস, একটু বেশী সময় মিলত উইকএন্ড-এ। একটু আলসেমি করা, বাজার করা, বৌ-দিকে জ্বালাতন করা তারপর চলত এদিক ওদিক আড্ডার আসর। সকাল থেকেই ঝিম ঝিম করে বৃষ্টি। কখন যে থামবে তার নেই কোনও ঠিক ঠিকানা, আজ বিকাল চারটায় আবার আমীর-দের বাড়ি যাবে... কথা দিয়েছে। ধুর, খেয়ালই হয় নি জিজ্ঞেস করতে বাড়িতে কে কে থাকে। নাই বা হ'ল, ... খোলা মনের লোক হবে হয়ত সবাই। নইলে কি আর দুম করে, বলতে গেলে প্রায় এক অচেনা অজানা লোককে, নিমন্ত্রণ করে বসবে! পথে সত্যনারায়ণ-এর মিষ্টির দোকানটা চোখে পরতে বেশী বাড়াবাড়ি না করে গোটা কয়েক চমচম আর সিঙ্গাড়া কিনে নিয়ে হাঁটা দিল।

আঃ, আমীরের ঠিকানার কাগজটা ভিজে গিয়েছে একটু - বাড়ির নম্বরটা ঠিকমত পড়া যাচ্ছে না। নামটাতেও কেমন খটকা লাগছে ... খান চক্রবর্তী! তা আর কি হবে খটকা লাগলে। এক ছোট ছেলেকে জিজ্ঞাসা করতেই বলল-
- ওঃ নাসিম মাসীর বাড়ি। ঐ ত' দুটৌ বাড়ির পরেই।
যাক বাবা - ওরা এখানে বেশ পরিচিত বলে মনে হচ্ছে।

কলিং বেল টেল নেই - দরজা নক্ করতেই এক ভদ্রমহিলা দরজা খুলে হাসিমুখে বললেন -
- দিবাকর বুঝি! এস ... তুমি করেই বললাম কিন্তু। আমি আমীর-এর মা।
- আর এ পাড়ার মাসীমা?
- ওরে বাবা, সে খবর দেখছি ইতিমধ্যে পেয়ে গিয়েছ!
- তাহলে আমিও আপনাকে মাসীমা বলব!
মিষ্টির প্যাকেটা নাসিম মাসীর হাতে দিয়ে দিবাকর মৃদুস্বরে বলল-
- আর মাসীমা, এ গুলো পথে পেয়ে গেলাম...

আমীর বসার ঘরে ঢুকতেই নাসিম মাসী -
- দেখেছিস দিবাকরের কান্ড!
- কী কাণ্ড-ফাণ্ডর কথা বলছ মা! দিবাকরকে তো বসতেই বল নি।
- আরে তাইতো.. ছিঃ ... তুমি বস দিবাকর। কথা বল তোমরা, আমি আসছি একটু বাদে।

বেশ ছিম ছাম বসবার ঘরটা। অতিরিক্ত আসবাবের বালাই নেই একদম ... একটা কাচের আলমারি। ঠাসা বই। আর একটা ফ্রেমে বাঁধান ছবি ... দিবাকরের উত্‌সুক দৃষ্টি নজরে এসেছে আমীরের।

- আমার বাবার ছবি। সুব্রত... সুব্রত চক্রবর্তী ছিল তাঁর নাম।

দিবাকর তাকাল আমীরের দিকে।

- সে অনেক দিনের কথা..., মানে আমি তখন খুব ছোট, আর জয়া আমার বোনটা তো ছিল আরও ছোট। উনি আমাদের ছেড়ে গিয়েছেন। আর আমাদের বড় করবার সব ভার বইতে হয়েছে মা-কে। একাই।

আরে দেখেছ জয়া ওর বইগুলি টেবিলটার ওপর ছড়িয়ে রেখেছে।

- আরে, তাতে হ'লটা কী! তোমার বন্ধু কি বইগুলো পরে ফেলবে... ক্ষতি কি তাতে, জ্ঞান বাড়বে। এই নাও চা নিয়ে এসেছি সবার জন্যে ... সার্ভ-টার্ভ কিন্তু তোমাদেরকেই করতে হবে।

টেবিলের ওপর ট্রে-টা রেখে। জয়া গিয়ে বসল ধপাস করে একটা চেয়ারে।

নাসিম মাসী এক থালা বোঝাই পেঁয়াজি আর কতগুলি ছোট প্লেট নিয়ে হাজির।
- এগুলো সব জয়ার করা।
- কি বলছেন মাসীমা... জয়া এ সব করতে পারে!
- মা, দেখেছ - দাদা-টা কাকে ধরে নিয়ে এসেছে। ... আঃ তোমার অত্তবড় নাম কিন্তু আমি বলতে পারব না। কী বলা যায়! ... দিবা। নাঃ দীপদা বলবো তোমাকে। রাজী তো!
- রাজী তো!... খুউব রাজী। দীপ ...ই আমার ডাক নাম... প্রিয় নাম।
- আরে দীপদা ... নামটা তো প্রিয় তা লোকটাকে ত' প্রিয় হতে হবে।

নাসিম মাসী হাসতে হাসতে ভর্তসনা সুরে জয়াকে বললেন
- তোর ঠোঁটটা কাটা... প্রিয় হতে হবে কী রে ... প্রিয় করে নিতে হবে যে।
- জয় হোক মাসীমার।

এই হাসি ঠাট্টা আর কয়েক দফা চা-পেঁয়াজিতে বিকেলটা কেটে গেল আর তারই সাথে সব দূরত্ব ... এক নিমেষে।

***

এরপর কতবার যে দিবাকর আমীরদের বা[ড়ি গিয়েছে ক' গ্যালন চা আর মুড়ি, তেলেভাজা শেষ করেছে তার হিসেব আর কে রাখতে যাচ্ছে। একদিন সন্ধ্যায় গড়িয়াহাটের রাস্তায় দিবাকরের সাথে ফুর-ফুর করে ঘুরে বেড়াবার সময় জয়া বলল...

- এই দীপদা, মাকে একবার টেনে হিঁচ্‌ড়ে বাড়ি থেকে বার করা যায় না! গোটা সপ্তাহ স্কুল, টিউশনি। তাছাড়া ক'টা গরীব ঘরের ছেলে-মেয়েকে ফ্রী-তে পড়াশুনা শেখায়। অবশ্য মা-র সময় না থাকলে বাচ্চা-গুলোকে আমরা একটু আধটু হেল্প করি। আসলে ওটা কিন্তু মা-কেই হেল্প করা। আর জান দীপদা ছেলে-মেয়েগুলি আমাদেরকে বেশ ভালবাসে। দাদা-টা একদম হাঁদা... ওর কোনও প্ল্যান-ফ্যান মাথায় আসে না।

- তোমার মাথায় বুঝি খুব প্ল্যান আসে?
- ঐ যে, তোমাকে বললাম ... বাড়ির একজন করলেই হল আর কি।
... বাড়ির একজন করলেই হল! হ্যাঁ, দীপকে ত' ওরা বাড়ির একজন-ই ভাবে, মানে তার বাইরে আর ভাবতেই পারে না।
- সিনেমা গেলে কেমন হয়!
- আরে দীপদা, তুমিও দেখছি বুদ্ধু ... মা বেরুবে আমাদের সাথে সিনেমা দেখতে। কি বুদ্ধি আমার ... পাগোল না, মাথা খারাপ!
- ও.কে. জয়া ট্রাই করে দেখা যাক না ... তারপর, না হয় দেখা যাবে বুদ্ধির ঢেঁকিটা কে! ... আরে, আর কতক্ষণ এই গড়িয়াহাট মোড়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেওয়া যায়!
- তাই তো, চল বাড়িতে চা খাওয়াবো।
- না, আজ থাক সেটা, তার চেয়ে চল বরং ঐ রেস্টুরেন্টটাতে এক কাপ চা আর একটা ভেজি-চপ মেরে দিই।
- আমি তাহলে প্রন নেব।

***

- ঐ তো ৫ নং বাসটা আসছে... আমি কাটছি দীপদা। তুমি কাল বিকেলে আসবে কিন্তু... অফিস থেকে সোজা।

- না, বাড়ি হয়ে আসব। বৌ-দি টা বসে থাকবে নইলে। ... চলি।

***

রাস্তা তেমন জ্যাম ছিল না, অফিস থেকে সকাল সকাল-ই ফেরা গেল। বাড়ি আসতে না আসতেই বৌ-দির হাতের চা এসে হাজির।
- বৌ-দি, আমি চা টা খেয়েই বেরিয়ে পরব, মানে এক্ষুণি ...
- আহা, ঘোড়াটা যে বেধে রেখে এসেছ, বুঝতেই পারছি। তা, কোথায় যাওয়া হচ্ছে দিগ্‌গজ বাবুর... শোনা যায়!
- আরে কোথাও না, ... ঐ জয়াদের বাড়িতে।
- জয়া! আজকাল দেখছি ঘন ঘন জয়া... জয়ার জয়ধ্বনি নাকি!
- আরে, দ্যুৎ বৌ-দি, কি যে বল। ওরা আমার দারুন বন্ধু... ও সব কিছু নয়। কিছু থাকলে তোমাকে বলব না - তাই হয় না কী!
- তাই বুঝি?
- তাই তো, বৌ-দি তো বন্ধু ... "এমন বন্ধু আর কে আছে?..."
- আঃ বড় ফাজলামি তোমার ...সব সময় সিনেমার ডায়লগ!
- ফাজলামি! বৌ-দি মানে কি জান! বস, আরে বস না বৌ-দি ... বলছি তোমাকে, মন দিয়ে শোন, একদম মন দিয়ে শুনবে কিন্তু। বৌ-দি হচ্ছে... একটা মানুষের মধ্যে বন্ধু, ভাই, বোন, দিদি এমন কি মা-ও, হ্যাঁ মা বলো বন্ধু বল সব কিছু।... আর.

... নজরটা পড়ল বৌ-দির দিকে... ফ্যাঁত ফ্যাঁত করে কাঁদছে।

- কাঁদছ বৌ-দি!
- নারে বোকা, কাঁদছি না ... এটা আনন্দ। হাঁদারাম কোথাকার!! যাও এখন তাড়াতাড়ি ফিরবে কিন্তু।
-আচ্ছা... চেষ্টা করব।

***

... ক্রমশ

1 comment: