দেশ বিদেশ, পথে-ঘাটে, লেখনী, প্রবাসীর চিঠি

Tuesday 2 March 2010

পথে-ঘাটে ৭ ... ঝরা পাতা

পথে-ঘাটে
ঝরা পাতা

ক্ষণিকের নীরবতা। নাসিম মাসী কারও দিকে না তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন পিছনে রেখে আসা দিনের কথা ...

আমার ছোট বেলার দিনগুলি কেটেছে সহজ, স্বাচ্ছন্দ্যে। বিলাসিতা আর আর্থিক বিশেষ সচ্ছলতা না থাকলেও বাবা-মাএর আদর, ভালবাসার অভাব ছিল না কখনও। আর ছিল না কোনও বাধা-নিষেধ, পাড়ার ছেলে-মেয়েদের সাথে মিশতে, খেলতে আড্ডা মারতে ছিল না বাপ-মাএর কোনও বকা-বকি আর চোখ রাঙ্গানো শাসন।

মাঝে-সাঝে অবশ্য মাকে বলতে শুনেছি,
- মেয়েটাকে আদর দিয়ে বড় বখাটে করে তুলেছ, বাড়ির কাজের বালাই নেই কোনও ... সব সময় পাড়া ঠেঙ্গানি। বাবা তখনই বলত...
- আরে ছাড় তো তোমার ওই বাড়ির কাজ, যখন দরকার হবে তখন ও আপনি-ই শিখে নেবে। পাড়ার ছেলে-মেয়েদের সাথে একটু খেলছে - তাতে হ'লটা কি! ওর ইস্কুলের প্রগ্রেস রিপোর্টগুলো তো দেখেছ, আর কি চাই?

ব্যাস, মার মুখ হ'ত বন্ধ। আর আমি খুশিতে উঠতাম নেচে, ধেই-ধেই করে এ পাড়া ও পাড়া ঘুরতাম সাঙ্গ-পাঙ্গদের সাথে। আর আমার কাছে বাবা ছিল তখন যে কোনও হিরো থেকে বড়।

সে সময়, ভারতের স্বাধীনতার পর মাত্র কতগুলি বছর কেটেছে, ... কলকাতার আশে-পাশে নূতন শহরতলি গড়ে উঠছে। বিশেষ করে আমাদের এই দক্ষিণ কলকাতার শহরতলিতে চারদিকে নিত্য নূতন কলোনির সৃষ্টি হচ্ছে তখন ... ভারত ভাঙ্গার পর পূর্ব বঙ্গের ভিটে থেকে উৎখাত হওয়া অগণিত পরিবার কোনমতে মাথা গোঁজবার ঠাঁই করে নিয়েছে এই সব এলাকায়। বাঁশের চাটাই ঘেরা টালির অথবা টিনের চালা ঘর।
দেখেছি, যাদের পক্ষে সেটা সম্ভব হয় নি, তারা থাকত শিয়ালদা স্টেশনের চারদিকে, হাওড়া আর অন্য সব ব্যস্ত সড়কের ধারে, রেল লাইনের আশে-পাশে, বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার বাস্তুহীন কুকুর-বিড়ালের সাথে ওদেরই মতন একটুকু জমি ভাগাভাগি করে। কখনও পেটের দায়ে ওই কুকুর-বিড়ালের শরিক হয়ে সন্ধান করেছে খাদ্যর, ডাস্টবিন থেকে ডাস্টবিনে।

বাবার কাছে শুনেছি, স্বাধীনতার মূল্য দিতে হয়েছে ভারত ভেঙ্গে, বাংলা আর পাঞ্জাব ভেঙ্গে - দেশটাকে খণ্ড-বিখণ্ড করে। হিন্দু-মুসলমান ভাই-ভাইয়ের রক্তাক্ত লড়াই, - এ বর্বরতার বলিদান হয়েছে লক্ষ লক্ষ জীবন। ছারখার হয়েছে শান্তি আর সম্প্রীতি । এই বর্বরতার দুর্যোগের সময় পাড়ার হিন্দু বন্ধুরা আশ্রয় দিয়েছে আমার মুসলিম বাবা-মাকে, তাদের জীবন রক্ষা করেছে।

শুনেছি, ভাঙ্গা দেশটার অপর অংশেও ছিল এই একই দুর্ভাগ্যের চিত্র।
খুব খারাপ লাগত এ সব শুনে, কিন্তু কেন যে এ সব ঘটেছে তার উত্তর ছিল না সে সময়, আমার মত ছোট মেয়ের মগজে।
আজও মনে পরে আমার ছোট বেলার সেই দিনগুলি ...

সে সময় এ শহরতলি আর তার চতুর্দিকে সব এলাকা ছিল না এতটা ঘিঞ্জি, আম, কাঁঠাল আর অন্য সব ফলের গাছের অভাব ছিল না কোথাও। স্কুলের ছুটি হতে না হতেই ছুটতাম আমরা এ পাড়া-ওপাড়া। কখনও জাম, জামরুল - কখনও বা বহু কাঁটা হজম করেও কুল চুরি করা। টক কাঁচা আমের প্রলোভন কোনও মাসি, বৌ-দি বা দিদির বকুনি আর ধমকানি বন্ধ করতে পারত না তখন। কোথাও খোলা মাঠে পা ছড়িয়ে অথবা গাছের ডালে বসে পা দুলিয়ে মনের সুখে নুন দিয়ে খেয়েছি আমরা কাঁচা আম ... যতক্ষণ না দাঁতগুলি শির শির করে উঠত।

বাড়ির কাছেই ছিল বড় এক শিউলি গাছ, সকালে শিশির ভেজা ঘাসের ওপর ছড়িয়ে থাকা ফুল সংগ্রহ করতাম বন্ধুদের সাথে - আঁচল ভরে। শিউলি ফুলের সে সৌরভ এনে দিত প্রতিদিন গোটা বাড়িতে স্নিগ্ধ মধুরতা।

এদিক ওদিক বসত সে কালে নানা রকম মেলা, - মেলায় পাঁপর খাওয়ার লোভ ছিল সব ছেলে মেয়েদের... আর আমারও বইকি।

বাস-টাস তো ছিল না এ সব এলাকায়, পায়ে হেঁটেই যেতাম আমরা কাছে, দূরে যত সব পাড়ায়। রিক্সার পয়সা আর মিলবে কোথা থেকে! সে সময়, চড়ক মেলা বসত বেশ দূরে, পশ্চিম পুটিয়ারীতে, - কুঁদঘাটের খাল পেরিয়ে যেতে হ'ত। সে সময় বলা হ'ত - 'আদি গঙ্গা' ... হ্যাঁ, নৌকাও চলত সে সময় ওখানে, দূর গ্রাম থেকে আসত শাক-সব্জী আর হরেক রকম মালপত্র ওই জলপথে। ছিল না কোনও ব্রীজ বা সাঁকো - খেয়া পার হ'তে হত তখন ঐ ঘাটে।
ওঃ, সেই দিনগুলি মন্দ ছিল না, বেশ রোমাঙ্চকর ছিল ওদিক আসা-যাওয়া।

বিশেষ কোনও বাধা নিষেধ ছিল না বাবা-মার - তবে সন্ধ্যার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হ'ত। ছিল না ধর্মের কোন গণ্ডি, - সব উৎসবে, সার্বজনীন পূজায় যেতাম সবাই দল বেঁধে পাড়া থেকে পাড়ায়, মণ্ডপ থেকে মণ্ডপে। দুই ধর্ম... মনে হ'ত একই ঘরের দুটো জানালা। ভালই লাগত - দুই ধর্মের উতসবেই মিলত নূতন পোষাক। সেবার ক্লাস নাইনে নূতন বছর সবে শুরু। সন্ধ্যাদি, আমাদের ইতিহাস দিদিমনি আমার ওপর চাপিয়ে দিলেন স্কুলের সরস্বতী পূজার চাঁদা তোলা আর মণ্ডপ সাজানোর দায়িত্ব। আমি আপত্তি করে বললাম..
- আমাদের বাড়িতে কোনও পূজা হয় না, আমি কি করে এই কাজের ভার নিতে পারি!
- আরে নাসিম, আমাদের বাড়িতেও কোনও ধরনের ধার্মিক অনুষ্ঠান হয় না,- আমাদের পুরো পরিবার কমিউনিস্ট ‌এবং নাস্তিক। তবুও বড়দিদিমনি আমার ওপর পূজার পুরো ব্যবস্থাপন দায়িত্ব চাপিয়েছেন। যদি আমরা ধরে নিই যে কোনও ঈশ্বর আছে, তা হলে তার কাছে সব মানুষ সমান, নেই কোন ভেদাভেদ। এই ধর্ম নিয়ে আমরা মানুষেরাই করছি মারামারি, কাটাকাটি - অর্থহীন ভাবে। আচ্ছা, জোর করছি না, তুমি তোমার বাবা-মাকে জিজ্ঞাসা করে দেখবে, আশা করছি তাঁদের কোনও আপত্তি থাকবে না। - বললেন সন্ধ্যাদি।
বাবা-মার বিন্দুমাত্র আপত্তি ছিল না এতে, তাই কোন অজুহাত আর রইল না, অগত্যা কাজের ভার নিতে হ'ল।
এতদিন কত বাচ্চা-পনা করেছি - এখন পূজা অর্গানাইজেশন কমিটি-তে দায়িত্বপূর্ণ কাজ শেখা শুরু। তবে এই কাজের অজুহাতে ক্লাস ফাঁকি দেবার সুযোগ ও পেয়েছি অনেক। আর বাড়ি ফিরতে দেরি হলেও ছিল না কোন বকুনি। পূজা অনুষ্ঠানের আগে সব মেয়েদের সাথে সারা রাত জেগে মণ্ডপ সাজানো পূজার আয়োজন করা... ছিল এক অভূতপূর্ব, সুন্দর অভিজ্ঞতা।...
পূজার দিনটা গত হ'ল, গত হ'ল সে বছর, আর দেখলাম সরস্বতী ক্ষুণ্ণ হন নি আমার ওপর। এর পর, একদিন শেষ হ'ল স্কুল যাওয়া-আসার দিনগুলি। ঝরা পাতার মত খসে পড়ল দিনগুলি এক এক করে ...

শেষ হ'ল ছোট-বেলা।

***
ক্রমশ

9 comments:

  1. আপনার গল্পটা খুব ভালো লাগছে, একটু তাড়াতড়ি লিখেন না দাদা ... শুভ কামনা রইল

    ReplyDelete
  2. সুন্দর লিখেছেন পড়ে খুব ভাল লাগল

    ReplyDelete
  3. Hi,
    This is such a great resource that you are providing and you give it away for free. I enjoy seeing websites that understand the value of providing a prime resource for free. I truly loved reading your post.
    Thanks!

    ReplyDelete
  4. ওয়েবসাইটি আপডেট করুন. ভালো ওয়েবসাইট.
    http://bairedure.blogspot.com/ একটি ভ্রমনের ওয়েবসাইট কোনও ভ্রমনের অভিজ্ঞতা থাকলে এখানো শেয়ার করতে পারেন

    ReplyDelete
  5. অনেক ভাল লাগল,আপনাকে ধন্যবাদ,এরকম একটা লেখা উপহার দেওয়ার জন্যে
    পারলে এই সাইটে একটি লাইক দিবেন
    http://www.statenewsbd.com/

    ReplyDelete
  6. If you want to income money at Home. Please visit this website: www.megatypers.com/register yourself there. The activation code: 3J4E Thank you all.

    ReplyDelete
  7. অনেক ভাল লাগল,আপনাকে ধন্যবাদ,এরকম একটা লেখা উপহার দেওয়ার জন্যে।।

    ReplyDelete
  8. www.bdtender.com একটি অনলাইন টেন্ডার/দরপত্র বিজ্ঞপ্তি পরিসেবা পোর্টাল। যেখানে বাংলাদেশের প্রায় সকল টেন্ডার/দরপত্রের (সরকারী এবং বেসরকারী সংস্থা থেকে প্রকাশিত) সাম্প্রতিক তথ্য প্রদান করা হয়। প্রায় ২০০০ নিবন্ধিকৃত সদস্যদেরকে নিয়মিতভাবে ইমেইলের মাধ্যমে সেবা প্রদান করে যাচ্ছে।
    দেশের সকল জাতীয় এবং আঞ্চলিক দৈনন্দিন সংবাদপত্র, প্রায় ৫৭ টি কাগজ এবং ২৫০টি ওয়েবসাইট থেকে টেন্ডার/দরপত্র সংগ্রহ করা হয়। সেইসাথে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা, এনজিও এবং বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা,তাদের প্রয়োজনীয় টেন্ডার/দরপত্র বিজ্ঞপ্তি সমূহ এই সাইটে প্রকাশ করে থাকে।

    ReplyDelete